You are currently viewing যন্ত্রভিত্তিক কর্ণপিশাচ

যন্ত্রভিত্তিক কর্ণপিশাচ

Share this post

কলমে - Subhrajoti Mazumder

কি ভয় ধরে গেলো? তারানাথ তান্ত্রিক গ্রন্থে সেদিন কর্ণপিশাচের কথা পড়ছিলাম। একধরণের জাদু বিদ্যা বলা চলে। বিশেষ উপায়ে এই ধরণের সাধক বিশেষ প্রকারের এক ক্ষমতা অর্জন করে থাকে নাকি। তাতে ভূত ভবিষ্যত বর্তমানের অজানা কথা প্রেত এসে নাকি কানে বলে যায়। ইতিমধ্যে বেশ কিছু বই পড়ে Mentalism র কথা পড়েছি। মেন্টাল শুনে আবার পাগলের প্রলাপ মন করবেন না যেন। লোকের আচরণ ভাবভঙ্গিমা থেকে তথ্য সংগ্রহের বিজ্ঞান বলা চলে। তাথেকে বোঝা গেলো পশ্চীমা মনোবিদ্যার Mentalism এর উচ্চ স্তর হল ভারতীয় কর্ণপিশাচী বিদ্যা। এতে জাদু বিদ্যা বা ভূত প্রেত বলে কিছু নেই। আমাদের দেশে ধর্মব্যাবসা এতটাই প্রচলিত যে এধরণের অদ্ভুত ক্রিয়া আগড়ুম বাগড়ুমের মধ্যে আসল ক্রিয়া গোপনে রাখা হয়। 

যাইহোক ওসব থাক হঠাৎ খামোকা সক্কাল সক্কাল কর্ণপিশাচ নিয়ে পড়লাম কেন? আসলে আমার ক্যামেরা NFC যুক্ত। NFC ব্যাবহারে ক্যামেরা থেকে মোবাইলে ছবি নিচ্ছিলাম। আমার মাথায় ভূত চাপে ছেলেবেলা থেকেই তাই NFC জিনিস টা কি সেটা নিয়ে ভূত চাপলো। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের গর্ব জগদীশ চন্দ্র বসু NFC সম্পর্কে জানতে কিছুটা সাহায্য করলেন। NFC মানে (Near Field Communication) এর ভিত্তি বলতে গেলে কিছুটা হলেও তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ। ১৮৬২ পদার্থবিদ ও গণিতজ্ঞ জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ত্বড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেন। ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দে বিজ্ঞানী হাইনরিখ হার্ৎজ সেটা প্রমাণ করেন। তার কিছুবছর পর কলকাতা টাউনহলে দিগন্ত রচিত হয়। 

গোঁড়া ব্রাহ্মন্যবাদী সমাজে তখন বিজ্ঞান নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিলোনা। যদিও ১৮৭৬ সালে ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার IACS (Indian Association for Cultivation of Science) গঠন করেন। ইতিমধ্যে ১৮৯১ সালে ভূবিজ্ঞানী পরম নাথ বসু Indian Industrial Association গঠন করেছেন। তাও বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তখনও তেমনভাবে পোক্ত হয়নি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে পাস করা শিক্ষিত কিছু মানুষের আগ্রহ ছিলো বলা চলে। 

১৮৯৪ সালের সেই দিন টাউনহলে শহরের কিছু শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন লাটসাহেব। ব্রিটিশ সরকারী তর্জমায় লেফটেন্যান্ট গভর্ণর স্যার উইলিয়ম ম্যাকেঞ্জি। বিশেষ যন্ত্র নিয়ে বিজ্ঞান আচার্য এলেন ও হলের মাঝখানে রাখা টেবিলে যন্ত্রটি রাখলেন। ঠিক গভর্নরের দিকে তাক করে। গভর্ণরের উল্টোপিঠে দেওয়াল ভেদ করে ওপাশের ঘরে একটি বৈদ্যুতিন বেল রাখা ছিলো। মুচকি হেঁসে তিনি যন্ত্রটি চালু করলেন। মুহুর্তেই একটি অদ্ভুত অদৃশ্য রশ্মি গভর্নরের শরীর ও মোটা দেওয়াল ভেদ করে ৭৫ ফুট দূরে রাখা একটি বৈদ্যুতিন বেল কে বাজিয়ে দেয়। গভর্ণর সহ গোটা হল বিস্মিত হয় এই ঘটনায়। কিন্তু ব্রিটিশ ভাষ্যে একজন নেটিভ ভারতীয়ের বিজ্ঞানসাধনার এই পরাক্রম স্বীকার করলে ইয়োরোপীয় আঁতে ঘা লেগে যায়। তাই একপ্রকার বিজ্ঞানআচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর এই আবিষ্কারকে অস্বীকার করা শুরু হয়। ধাতব ইউ আকৃতির পারদ ভর্তি টিউব দিয়ে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু Coherer যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন যার মধ্য দিয়ে সুচারু ভাবে ত্বড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি করা যেত। মিলিমিটার ওয়েব সম্পর্কে আমরা এখন যা জানি তারও আবিষ্কর্তা জগদীশচন্দ্র বসু। কিন্তু দূর্ভাগ্য সম্ভবত এর  ইতালীয় পদার্থবিদ ও আবিষ্কারক গুগলিয়েমো মার্কনি  মার্কনি Wireless Telegraph আবিষ্কার করেন। দীর্ঘদিন তিনি এই আবিস্কারের পেছনে বিজ্ঞানআচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর কৃতিত্ব স্বীকার করেননি। মার্কনি যে Coherer র পেটেন্ট নিয়েছিলেন সেটাও জগদীশচন্দ্রের বানানো Coherer র অবলম্বনে বানানো। প্রথমে স্বীকার করলেও পরে ডানলপ বুকের ৯৫ নং পৃষ্ঠায় মার্কনি তার আবিষ্কারের ক্ষেত্রে জগদীশচন্দ্রের অবদান স্বীকার করেছিলেন। আরএফআইডি, NFC, রেডার প্রযুক্তির যে ভিত্তি মাইক্রোওয়েভ তারও আবিষ্কারক বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। এ তো গেলো মাইক্রোওয়েভের কথা। এবার আরেকটি গল্পে আসি। কেন কর্ণপিশাচ বললাম সেটাও তো জানতে হবে তো? 

সাল ১৯৪৫ সদ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মিটেছে। কিন্তু পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশ ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে মতাদর্শগত লড়াই এক অন্য বাঁক নিয়েছে। আকচা আকচি ঝগড়াও তো বিজ্ঞানকে একটা নতুন দিশা দেখাতে পারে। এখানেও সেটাই হয়েছে। স্থান মস্কো। সোভিয়েতে তখন শরৎ কাল। আমাদের এখানকার শরৎ ওখানকার শরৎ একরকম নয়। সেখানে শরতের মাধুর্য আছে। ৪ ঠা আগষ্ট ফুটফুটে শিশুদের একদল মষ্কোর মার্কিনী দূতাবাসের বাইরে জড়ো হয়েছে। সোভিয়েত কমিশারিয়েটের উচ্চপদস্থরা উপস্থিত সেখানে। শিশুর দল এসেছে ভ্লাদিমির লেনিন অল ইউনিয়ন পাইওনিয়ার অর্গানাইজেশন থেকে। সবাইকার মুখে হাসি। চারিদিক নানা রঙে সাজানো। দূতাবাসের মুখে লাগানো তোরণে একদিকে মার্কিনী একদিকে সোভিয়েত রক্তপতাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ত শক্তিকে পরাস্ত করার জন্য শুভেচ্ছা বিনিময়ের কর্মসূচী ছিলো সেদিন। ফুটফুটে জনা চারেক শিশু এগিয়ে গেলো মার্কিনী দূতাবাসের গ্যালারির দিকে হাতে একটি কাঠের সুসজ্জিত তোরণ। তাতে মার্কিনী প্রতিক ঈগলের ছবি। শিশুগুলির মুখগুলি বড়ই মায়ামাখা। প্রত্যেকের গলায় লাল স্কার্ফ মেয়েদের পরণে গোলাপী ফ্রক ছেলেদের পরনে সাদা জামা কালো প্যান্ট। সবাই একযোগে রুশ ভাষায় কিছু বললো। হেঁসে প্রত্যুত্তর দিলেন মার্কিনী রাষ্ট্রদূত অ্যাভারেল হ্যানিম্যান। বিষয়টা সেখানে মিটে যেতে পারতো কিন্তু মিটলো না। আপনারা কেউ থেরামিন বাদ্যযন্ত্রের কথা শুনেছেন? যন্ত্রটির সুর ভায়োলিন ও চেলোর সুরের মিশণ বলা চলে। ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করতে আগে ইয়োরোপীয় অপেরায় খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো এই থেরামিন। বিশ্বে গুটিকয়েক মানুষ এই যন্ত্রটি বাজাতে পারেন সম্ভবত। এই থেরামিনের আবিষ্কর্তাকে কেউ জানেন কি? নাম লিওন থেরামিন। লিওন থেরামিন ছিলেন পদার্থবিদ ও আবিষ্কারক। মজার কথা থেরামিন সেন্ট পিটারসবার্গে যে বছর জন্মেছিলেন ঠিক সেই বছর পৃথিবীর অপরপ্রান্তে মার্কনি ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করেন। তার ২ বছর আগে জগদীশচন্দ্র টাউনহলে সেই এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়েছিলেন। রুশ এনকেভিডি বা পরবর্তীকালে কেজিবির প্রধান তখন ছিলেন বেরিয়া। সারাস্কা গুলাগে কাজ করার সময় কেজিবির নির্দেশে থেরামিন একটি চরবৃত্তির যন্ত্র তৈরি করেন। যন্ত্রটিতে ছিলো একটি পর্দা ও একটি ওয়্যারলেস সিষ্টেম ছিলো। লো ফ্রিকোয়েন্সি মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনে এই ওয়্যারলেস লিসনিং ডিভাইসটি চলতো। এই যন্ত্রটি খুব সন্তর্পনে মার্কিনী ইগলের ওই সিলের ভেতর প্রতিস্থাপিত করা হয়। 

দূতাবাসের ৮০০ মিটার দূরে একটি আবাসনে কেজিবির একজন রেডিও অপারেটর বসতেন। যন্ত্রটিতে কোন ব্যাটারি ছিলোনা। খুব লো ফ্রিকোয়েন্সি ত্বড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ মার্কিন দূতাবাসের সিল টির মধ্যে বসানো রিসিভার অ্যান্টেনায় পৌঁছাতো বড় এবং আরেকটি অ্যান্টেনা দিয়ে ভেতরের সমস্ত শব্দ বা ধ্বনি তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গে পরিণত হয়ে ৮০০ মিটার দূরে রিসিভিং অ্যান্টেনায় পৌঁছাতো। এতেই দূতাবাসের ঘরের ভেতরের যেকোন গোপন কথাবার্তা খুব সহজেই সোভিয়েত গোয়েন্দারা শুনতে পারতেন। কোন ব্যাটারি না থাকায় সহজে যন্ত্রটিকে ধরাও যেতনা। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ ধারাবাহিক এই গোয়েন্দাগিরি চলেছিলো। বাধ সাধলো পাশের ব্রিটিশ দূতাবাসের একজন রেডিও অপারেটর রেডিও রিসিভারে যখন এই কথোপকথন ধরে ফেলেন। সোভিয়েত বিজ্ঞানী এর নাম দিয়েছিলেন Endovibrator মাত্র ৩৩০ মেগাহার্টজ ফ্রিকোয়েন্সিতে মেশিনটি পরিচালিত হত। এখনও মার্কিনী ক্রিপ্টোগ্রাফিক মিউজিয়ামে যন্ত্রটি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিজ্ঞানের কোন আগড়ুম বাগড়ুম মন্ত্র তন্ত্র নেই কিন্তু বিজ্ঞান সত্য ও শাশ্বত। কর্ণপিশাচ বলার একটাই কারণ এর খারাপ দিকটা সম্পর্কে সচেতন করা। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন RFID, NFC র ভিত্তি এই BUG টি। আজ মোবাইল ফোন থেকে পকেটের ডেবিট কার্ড সবেতেই এই টেকনোলজি ব্যাবহৃত হয়। প্রশ্নটা এখন এটাই যে সরকার কত্তৃক এই প্রযক্তির ব্যাবহার কতটা নিরাপদ? আপনি আমি বা আমরা কি পরোক্ষভাবে গোয়েন্দাগিরির শিকার হচ্ছিনা তো? বাকি আমার গল্প ফুরোলো নটেগাছটি মুড়োলো।

Disclaimer:

  • The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
  • The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s). 
  • All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
  • No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).

Share this post

This Post Has 4 Comments

  1. Sankar Kusari

    Now what’s to be done ? Can we live without mobile or debit card ?

  2. Biswajit Roy

    Very Informative and well written article. Thanks to the Author.

  3. শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য

    চলতি ফর্মের বাইরে লেখা। তথ্য সমৃদ্ধ। বর্তমান সময়ে ভীষন উপযোগী। শাসকের যুক্তিবাদী সামিজক সত্তাকে নষ্ট করার বিরুদ্ধে এই লেখা হোক হাতিয়ার। কলম চলুক এই ভাবেই।

  4. Neveah Lyons

    You’re so awesome! I don’t believe I have read a single thing like that before. So great to find someone with some original thoughts on this topic. Really.. thank you for starting this up. This website is something that is needed on the internet, someone with a little originality!

Leave a Reply to শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য Cancel reply