You are currently viewing প্রান্তিক মানুষেরও বাঁচার অধিকার রয়েছে

প্রান্তিক মানুষেরও বাঁচার অধিকার রয়েছে

Share this post

২০১৩ সালে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিবেশের কথা চিন্তা করে ‘হকার’ পেশাকে আইনি স্বীকৃতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে সমস্ত রাজ্যের উচ্চ আদালতের মাননীয় প্রধান বিচারপতিদেরও নির্দেশ দেন, প্রত্যেক উচ্চ আদালতে একটি বিশেষ বেঞ্চ তৈরি করে হকার সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালে লোকসভায় হকারদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন করেন যে, প্রতিটি পুরসভাকে ‘ভেন্ডার কমিটি’ গড়তে হবে, হকারদের ব্যবসার জন্য বিশেষ এলাকা চিহ্নিত করতে হবে এবং এদের নথিভুক্ত করতে হবে। অতি দুঃখের বিষয়, কার্যত ভারতবর্ষের কয়টি পুরসভা বা পুরনিগমে এই আইন কার্যকরী হয়েছে, সে ছবি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কলকাতা উচ্চ আদালতেও বিশেষ বিচার প্রক্রিয়ার জন্য কোন বন্দোবস্ত করা হয়নি। এই বিষয়গুলিকে সামনে রেখে সম্প্রতি ‘আইন সহায়তা কেন্দ্র, চন্দননগর’ রাজ্য সরকারের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশিকা না মেনে হকার উচ্ছেদ এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার বিরুদ্ধে কলকাতা উচ্চ আদালতে দুটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছে।

ভারতবর্ষ বা পৃথিবীতে হকার শব্দ বা পেশাটি কোন নতুন বিষয় নয়। পৃথিবীর সমস্ত দেশে হকার হিসেবে বহু মানুষ তাদের জীবিকা অর্জন করেন। হকারদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে। এমনকি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ-এও হকার সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা হয়েছে। ভারতে প্রধানত দুই শ্রেণির হকার আমরা দেখতে পাই — রেলের কামরা, প্ল্যাটফর্ম বা স্টেশন চত্বরে এবং জনবহুল অঞ্চলে রাস্তার ধারে।

ভারতবর্ষে মোট ৮৭১৩টি রেলস্টেশন আছে। রোজ প্রায় ৩০০০ মেল/এক্সপ্রেস ট্রেন যাতায়াত করে। প্যাসেঞ্জার বা লোকাল ট্রেন যাতায়াত করে ১৩১৬৯টি। ভারতবর্ষে মেল/এক্সপ্রেস ট্রেন রোজ প্রায় ২ কোটি ২১ লক্ষ যাত্রী বহন করে। প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যাতায়াত করে রোজ প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ যাত্রী। এই সমস্ত ট্রেনে হকাররা যাত্রীদের নানান পরিষেবা দিয়ে থাকেন। রেল কর্তৃপক্ষ যে যাত্রী পরিষেবা দেয়, তা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। এই পরিষেবা মূলত উচ্চ শ্রেণির যাত্রীদের কথা মাথায় রেখেই। রেলের সাথে হকার ও তাদের পরিবার (পরিবার পিছু ৪ জন সদস্য) মিলে প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবন জড়িত। এখানে বলার, রেল ছাড়া দূরপাল্লার বাসেও হকারদের আনাগোনা থাকে, যদিও তার সংখ্যা সীমিত।

ভারতবর্ষে মোট ৪৬৫৮টি পুরসভা ও পুরনিগম আছে। এইসব পুর-এলাকাতে বেশ কিছু কর্মহীন মানুষ, বন্ধকল কারখানার শ্রমিক বা প্রান্তিক মানুষ হকার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে বেশ কয়েক কোটি মানুষ এই হকার পেশায় যুক্ত। হাউজিং অ্যান্ড আরবান পভার্টি অ্যালেভিয়েশন মন্ত্রক-এর তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে ১ কোটি মানুষ (ভারতের মোট জনসংখ্যার ০.৭১ শতাংশ) রাস্তার পাশে হকার হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। ন্যাশনাল হকার্স ফেডারেশন-এর সমীক্ষা (২০১৫) অনুযায়ী ভারতে ৪ কোটির বেশি হকার আছেন।

অসংগঠিত ক্ষেত্রে বাজারের খুচরো বিক্রেতা এবং হকারদের জীবন-জীবিকার প্রশ্নে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নির্দিষ্ট চিন্তাভাবনা রয়েছে। অসংগঠিত অর্থনীতিতে নানান জরুরি সামগ্রী এবং পরিষেবা জোগান দিয়ে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, দেশের আর্থিক অবস্থার মান বজায় রাখতে হকারদের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জাতিপুঞ্জ মনে করে। জাতিপুঞ্জের ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) উপরিউক্ত পেশার মানুষদের জীবিকা সংক্রান্ত নানান সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট। অসংগঠিত ক্ষেত্রে হকার এবং খুচরো বিক্রেতাদের আইনি স্বীকৃতি, সামাজিক সুরক্ষা দান এবং উন্নত কর্মক্ষেত্র নিয়ে আইএলও ভাবনাচিন্তা করে। জাতিপুঞ্জ প্রায়ই নানান নীতি চালু করার সুপারিশ করে যা হকারদের সংগঠিত (ফর্মাল) অর্থনীতিতে যুক্ত করার কথা বলে, সামাজিক সুরক্ষা দেয় এবং নিরাপদ কর্মক্ষেত্রেরও আশ্বাস দেয়। এই বিষয়গুলি জাতিপুঞ্জের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-র ৮ (উপযুক্ত শালীন কাজ এবং আর্থিক বিকাশ), ১০ (অসাম্য হ্রাস) এবং ১১ নম্বর (টেকসই শহর ও গোষ্ঠী) লক্ষ্যের সঙ্গে জড়িত। আর্থিক বিকাশ এবং নাগরিক দারিদ্র কমাতে এগুলিকে হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত এখানে বলার, স্ট্রিটনেট ইন্টারন্যাশনাল নামে এক আন্তর্জাতিক হকার সংস্থা আছে, যেটি রাস্তার ধারের বিক্রেতা, অসংগঠিত ক্ষেত্রে বাজারের বিক্রেতা এবং হকারদের এক বিশ্বজোড়া জোট।

আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল পরিযায়ী শ্রমিক। ভারতের লেবার অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট মন্ত্রক-এর প্রকাশিত প্রতিবেদন (২০.০৭.২৩) অনুযায়ী দেশে আন্তঃরাজ্য মোট পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৪.১৪ কোটি। এটি ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২.৯৬ শতাংশ। উল্লেখ্য, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর হিসেবে এই সংখ্যাটি ১৩.৯ কোটি (মোট জনসংখ্যার ৯.৯৩ শতাংশ)। অধিকাংশ এই আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের না আছে কোন আইনি স্বীকৃতি, না আছে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা। নানান সামাজিক মাধ্যমে মালিকদের হাতে এদের অত্যাচারিত হবার, এমনকি গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার হাড়-হিম করা ছবি আমাদের সামনে এসেছে। কোভিড-কালে এসব পরিযায়ী শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরার সময় কী অবর্ণনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল, তা এখনও আমাদের স্মৃতিতে সজীব।

হকার এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের, যারা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩.৬৭ শতাংশ, স্বার্থ রক্ষা করতে ‘আইন সহায়তা কেন্দ্র’ রাজ্যের ও কেন্দ্রের অসাংবিধানিক বুলডোজার নীতির বিরুদ্ধে আইনের দ্বারস্থ হয়েছে। ঈদ ও দুর্গাপুজোর সময় রাজ্যজুড়ে এই হকারদের ও খুচরো ব্যবসায়ীদের বিক্রিবাটা বাড়ে। সম্বৎসরের বাঁচার রসদ তাঁরা ঘরে তোলেন। তাই পুজোর মুখে এই বুলডোজার নীতি (যদিও প্রশাসনিক প্রধানের হস্তক্ষেপে আপাতত বন্ধ) এঁদের জীবন-জীবিকাকে এক অনিশ্চয়তার মুখে ফেলবে। এঁদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য দেশে আইন রয়েছে, অথচ সেই আইন যদি কার্যকর না হয়, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, মাননীয় বিচারপতিদের বেতন সংক্রান্ত সমস্যা নিরসনে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত তৎপর হয়েছেন। কিন্তু পাটকলগুলির অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি সহ অন্যান্য অবসরকালীন ন্যায্য পাওনা থেকে মালিকপক্ষ যখন তাঁদের বঞ্চিত করে, সেই সংক্রান্ত মামলা আদালতে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকে। মহামান্য আদালতের শোনার সময় হয় না। সমস্ত আশা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন মানুষ আদালতের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু সেখানেও বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। তাহলে সুবিচারের আশায় এঁরা যাবেন কোথায়? আমরা সকলেই চাই, আইনি অনুশাসন বজায় রেখে এইসব প্রান্তিক মানুষের সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার সুরক্ষিত হোক।

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় (পরিবেশ ও সমাজকর্মী )
চলভাষ – ৮৪২০৭৬২৫১৭
ই-মেল – biswajit.envlaw@gmail.com

এবং
রাহুল রায়, শিক্ষক ও পরিবেশ কর্মী,
চলভাষ- ৮৬১৭৭৪৫৩৪০,
ই-মেইল: rayrahul2263@yahoo.co.in

Disclaimer:

  • The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
  • The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s). 
  • All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
  • No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).

Share this post

Leave a Reply