You are currently viewing একটি মৃত্যু – গণজাগরণ – ন্যায়ের দাবি

একটি মৃত্যু – গণজাগরণ – ন্যায়ের দাবি

Share this post

৯ অগাস্ট, ২০২৪, আর জি কর হাসপাতালের ইতিহাসে এক অভিশপ্ত রাত। এই রাতে এই হাসপাতালের একজন তরুণী চিকিৎসকের শ্লীলতাহানি ও মৃত্যু হল। ১০ অগাস্ট ভোরবেলা এই তরুণীর মৃতদেহ প্রথম কে দেখেছে, তা আজও অজানা। হঠাৎ করে মেরুদণ্ডহীন বাঙালির মনোজগতে এই ঘটনাটি এক ভূমিকম্প সৃষ্টি করল। আতঙ্কিত হল সমস্ত মানুষ। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত সমাজ। ১০ অগাস্ট থেকেই মানুষ পথে নামল। এই লেখা যখন চলছে, তখনও বিচারের দাবিতে রাস্তায় মানুষ হাঁটছে। ক্ষোভ, অভিমান, রাগ, দুঃখ, যন্ত্রণা জনতার মুখ দিয়ে ঝরে পড়ছে। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। যেন বাঁধ ভাঙা মেঘের মতোন জনগণ আছড়ে পড়ল রাজপথে। নেই কোন দলীয় ঝান্ডা, কোন রাজনৈতিক নেতার আস্ফালন। কেবল কুড়ি-তিরিশ বছরের যুবক-যুবতীরা, সঙ্গে অসংখ্য মানুষের সমাগম। হঠাৎ করে মনে হল, বাঙালি তার প্রতিবাদী সত্তাকে অনেকদিন পর খুঁজে পেল। যেসব মা-বোনেরা জীবনে কখনো রাস্তার মিছিলে যোগ দেননি, তাঁরাও এসে রাজপথে দাঁড়ালেন। একটাই দাবি — অপরাধীদের শাস্তি চাই। আশেপাশে ঘটে চলা অসংখ্য দুর্নীতি, অপরাধ, শ্লীলতাহানি সবকিছুর বিরুদ্ধে এক চূড়ান্ত জনরোষ।

১০ অগাস্ট থেকে আন্দোলিত জনরোষ মনে করিয়ে দেয় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। ১৯০৫ সালে তদানীন্তন বড়লাট লর্ড কার্জন ঘোষণা করলেন বাংলাকে ভাগ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের থেকে শুরু করে একেবারে প্রান্তিক মানুষ গর্জে উঠল জাতিধর্ম নির্বিশেষে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে। সমস্ত ভারতবর্ষ নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আকস্মিকতায়। রবীন্দ্রনাথ গঙ্গাস্নান করে তাঁর বাড়ির মুসলমান কোচোয়ানের হাতে রাখি পরিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে আন্দোলনে যোগ দেবার আহ্বান জানালেন। স্বাধীনতা-উত্তর যুগের অন্যতম নাগরিক আন্দোলন জন্ম দিল এক নতুন আন্দোলনের চরিত্র, যা বর্ণিত হল- All changes changed utterly, a terrible beauty was born.

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল আন্দোলনের জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার যোগদান। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে ১০ অগাস্ট থেকে যে আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে, তাকে নিঃসন্দেহে নাগরিক আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করলেও সেই ভাবে প্রান্তিক মানুষের যোগদানের বিষয়টি অনেকটাই অনুপস্থিত। মূলত শহরকেন্দ্রিক লেখাপড়ার সঙ্গে যুক্ত বা মেধা বিক্রয় যাঁদের পেশা, সেই মধ্যবিত্তই এই নাগরিক আন্দোলনের কাণ্ডারী হয়ে উঠল। কোন নেতা বা রাজনৈতিক দলের আহ্বান নয়, কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের আহ্বানে কলকাতার রাজপথ রাতের বেলা দখল হল। রাত দখলের এই অভিনব কর্মসূচি এই আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা এনে দিল। হাজার হাজার মানুষ সুখশয্যা ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। একটি মাত্র স্লোগান — উই নিড জাস্টিস। এই বিচার চাওয়ার যে দাবি, সে দাবি থেকে উঠে এল এক নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব, যে প্রজন্ম সরাসরি প্রশাসনের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে, এমনকি তাদের বিচারের দাবিকে রাজ্য বা দেশের সর্বোচ্চ আদালতও মান্যতা দিতে বাধ্য হয়।

ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই কলকাতা উচ্চ আদালতে বেশ কয়েকটি জনস্বার্থ মামলা দাখিল হল। এমনকি আর জি করের ঘটনায় মৃত তরুণী চিকিৎসকের পিতা-মাতা রাজ্য প্রশাসনের উপর আস্থা হারিয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। আমাদের দুর্ভাগা দেশ। হতভাগা আর কাকে বলে? যে দেশে পাঁচ-পাঁচটি নোবেল লরিয়েট (সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিজ্ঞানে সি ভি রমন, মানবসেবায় মাদার টেরিজা এবং অর্থনীতিতে অমর্ত্য সেন ও অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়), বিজ্ঞানী সি ভি রমনকে বাদ দিলে আর চারজনই যেখানে এই রাজ্যের, সেখানেই কিনা তিলোত্তমার ওপর পৈশাচিক অত্যাচার ও হত্যার ঘটনা সহ রাজ্যের শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য দপ্তরে ও অন্যত্র দুর্নীতির ঘটনা আজ সারা বিশ্বের ‘টক অফ দ্য টাউন’। নিজেদেরই আজ এটা ভাবতে লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে যে, এই বাংলার সুসন্তান বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘বন্দেমাতরম্’ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবীদের মূলমন্ত্র ছিল।

তিলোত্তমার মৃত্যুর পর এক মাস পেরিয়ে গেল। সুবিচার আজও অধরা। তিলোত্তমার মৃত্যুর সুবিচার এবং রাজ্যের সর্বস্তরের দুর্নীতি দূর করার দাবিতে নাগরিক সমাজ গত একমাস যাবৎ পথে। নানান মতের নানান দলের জনস্রোতের একটাই ঠিকানা — ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। মাত্র ছোট্ট তিনটি শব্দ। অথচ কী দৃপ্ত সে অনমনীয় প্রত্যয়ে!

তিলোত্তমার খুন ও ধর্ষণ নিয়ে ভারতের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত যখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করে শুনানির আদেশ দেন, দেশের মানুষ সেদিন তাকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়েছিল। আসলে পুলিশ-প্রশাসনের ওপর সাধারণ মানুষ যখন ভরসা হারায়, তখন বিচার-ব্যবস্থাই তার আশা-ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেখানেও আদালতের সময় নেই এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলা শোনার! মাননীয় প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সরকারি নোটিশে জানিয়ে দিলেন যে মামলা পরে শোনা হবে। সেই ‘তারিখ পে তারিখ’। আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে অধুনা বাংলাদেশের রংপুর-এ ছাত্রসভায় বিশিষ্ট সুরকার সলিল চৌধুরী বিরচিত এই গানটি মনে এল — “বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা।” আজ গানটি কী প্রাসঙ্গিকভাবে উজ্জ্বল! আজও কিন্তু ছাত্রসমাজ দিন-রাত এক করে জাস্টিসের দাবিতে পথে জাগছে কিসের বাধা কিসের মানা সব উড়িয়ে।

কলকাতা উচ্চ আদালত সমস্ত শোনার পর অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করে রাজ্য প্রশাসনের কাছ থেকে তদন্ত প্রক্রিয়া ছিনিয়ে নিয়ে সিবিআই-কে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত নথি তুলে দেবার আদেশ দিল। রাস্তায় তখন উত্তাল জনতা। বিচারের দাবিতে, দ্রুত তদন্তের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গের গণ আন্দোলন সমস্ত ভারতের গণআন্দোলনে পরিণত হল। আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসী ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে আরম্ভ করল। এমনকি দিল্লির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালগুলির চিকিৎসকরাও আন্দোলনের শরিক হয়ে পড়লেন। এই অবস্থায় ভারতের সর্বোচ্চ আদালত আসরে অবতীর্ণ হল এবং মাননীয় প্রধান বিচারপতি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রক্রিয়া পর্যালোচনার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চালু করলেন। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক অর্থ খরচ করে ভারতের দামী ব্যবহারজীবীদের নিযুক্ত করা হল কেবল একটি কথাই সর্বোচ্চ আদালতে প্রমাণ করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যে, ৯ অগাস্ট, ২০২৪-এ আরজি করে যে হত্যালীলা সম্পন্ন হয়েছে, তা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং রাজ্য সরকার এই ঘটনার ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। পরপর তিনটি শুনানি সমাপ্ত। এই শুনানির এক এবং একমাত্র নির্যাস যে, রাজ্য সরকার কিছু গোপন করতে চাইছে এবং যেসব নথি এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে অস্বচ্ছতা প্রকটভাবে বিদ্যমান। সম্প্রতি সিবিআই যে প্রতিবেদন পেশ করেছে সর্বোচ্চ আদালতে, সেটি দেখে সর্বোচ্চ আদালত অত্যন্ত বিচলিত এবং সিবিআইকে তদন্ত সম্পূর্ণ করার জন্য আদেশ জারি করেছে। সর্বোচ্চ আদালতে বিচার চলাকালীন প্রধান বিচারপতি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, আরও একটি শ্লীলতাহানির জন্য আমরা অপেক্ষা করতে পারি না। অবিলম্বে সমস্ত হাসপাতাল সহ নানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য কমিটি তৈরি করে দিয়েছেন তিনি।

রাজ্য সরকার আর জি কর-এর এই ঘটনার পরে যেভাবে তদন্ত চালিয়েছে, তা দেখে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের এক মাননীয় বিচারপতি উক্তি করেছেন যে, তার দীর্ঘ ৩০ বছরের কর্মজীবনে এই ধরনের অবিন্যস্ত তদন্ত প্রক্রিয়া দেখেননি। এইসব উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকারের হতাশাজনক আচরণ। গণআন্দোলনের জোয়ারে রাজ্য সরকার বাধ্য হয়েছে জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবি মেনে কিছু পদক্ষেপ নিতে, যদিও এ সমস্ত পদক্ষেপই কেবল প্রসাধনী ব্যবস্থা। কিন্তু সমস্ত মেডিকেল কলেজ ও স্বাস্থ্য বিভাগে যে চরম দুর্নীতি চলছে, সে ব্যাপারেও রাজ্য সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত বিরক্তিকর। এই দুর্নীতির ব্যাপারেও উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তদন্ত প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে। বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও এটি দুর্নীতির হিমশৈলের চূড়া মাত্র। দুর্নীতি আজ মানুষের তিনটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় চাহিদার ক্ষেত্রে বিরাজমান — শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্য দপ্তর। আজকের এই গণজাগরণ যেন এসব দুর্নীতির অবসান চাইছে এবং অপরাধীদের শাস্তি দাবি করছে। এই গণআন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন ঘটাতে পারবে কিনা তা আগামী ইতিহাসই বলবে, তবে এই গণজাগরণ দেখে মনে হয় নিদ্রিত ভারত জাগছে এবং তারই মধ্যে যেন বিপ্লবের শঙ্খধ্বনি স্পন্দিত হচ্ছে। শেষে রবীন্দ্রনাথের ভাষাতে বলতে হয় — ‘মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় (পরিবেশ ও সমাজকর্মী )
চলভাষ – ৮৪২০৭৬২৫১৭
ই-মেল – biswajit.envlaw@gmail.com

Disclaimer:

  • The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
  • The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s). 
  • All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
  • No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).

Share this post

Leave a Reply