কথা শুরুর কথা
নদীমাতৃক ভারতবর্ষ সর্বত্রই সমানভাবে নদীসম্পদে সমৃদ্ধ নয়। নদীর জলপ্রবাহ তার জলধারণ ক্ষেত্রের আয়তন এবং প্রাকৃতিক উৎসস্থলের ধরনের উপর নির্ভরশীল। উত্তর ভারতের বরফ-গলা জলে পুষ্ট নদীগুলিতে সারা বছর কম-বেশি জল থাকে। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতের নদীগুলি একান্তভাবে নির্ভরশীল বর্ষাকালের বৃষ্টির জল বা ভৌমজলের ওপর। আবার, ভারতের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে মোহনা দিয়ে সামুদ্রিক জল জোয়ারে কিছু দূর অব্দি দেশের মধ্যে ঢোকে। কিন্তু এই জল নোনা বলে সরাসরি এর ব্যবহার নেই। কাজেই অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদ সূর্যালোক ও বাতাসের মতো মানুষের রোজকার জীবনযাত্রার অপরিহার্য জল অফুরান যেমন নয়, তেমনই তার প্রাপ্তিও সর্বত্র এক নয়। অথচ প্রয়োজন একই রকম।
প্রাকৃতিক কারণেই স্থান ও কালের ভিত্তিতে জলসম্পদের বণ্টনে বৈষম্য রয়েছে পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে। এই বৈষম্য নিয়েই নীল, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস, সিন্ধু, গঙ্গা, হোয়াংহো নদী অববাহিকায় গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। এসব সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মূলনদী-উপনদী-শাখানদী সব মিলিয়ে তার স্বাস্থ্য, তার জলধারণ ও জল সরবরাহের ক্ষমতা। তাই নদী মানেই তার প্রবাহিত জলধারার খাতটি মাত্র নয়, কয়েক হাজার বছর ধরে এই জলপ্রবাহে জমির ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যে উর্বর পলিস্তর জমেছে, সেখানে যে বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের সৃষ্টি হয়েছে, মানব সভ্যতার যে বিবর্তন ঘটেছে — সমস্ত কিছুই।
নদীকে জানা জরুরি
প্রধানত দুটি বিষয়কে মাথায় রেখে নদীকে জানতে হয়, (১) নদীর জলের উৎস কী এবং তার পরিমাণ কত এবং (২) নদী যে অঞ্চল থেকে জল সঞ্চয় করে, তার বিস্তৃতি। নদীর জল সঞ্চয় বা ধারণ অঞ্চলের চরিত্র নদী অববাহিকার আকার ও আয়তনের উপর নির্ভরশীল। একটি মূল নদী ও তার উপনদী-শাখানদী সব মিলে এক-একটি নদী ও তার প্রবাহপথ। এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠে তার অববাহিকা। বিভিন্ন নদীর অববাহিকা জলবিভাজিকা দিয়ে বিভক্ত। কোন নদী ব্যবহারের পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার সময় তাই নদীর সঙ্গে তার অববাহিকার সম্পর্কটিকে মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এইজন্যই নদী-ব্যবহার ও নদী-উন্নয়ন পরিকল্পনা নদী-অববাহিকা ধরেই করতে হয়।
মূলনদী-উপনদী-শাখানদীর দৈর্ঘ্য, প্রবাহিত অঞ্চলে ভূমির ঢাল ও জলপ্রবাহের মধ্যে সৃষ্ট ভারসাম্য গড়ে তোলে সমগ্র অববাহিকার বিশেষত্ব বা চরিত্র। অববাহিকার এই প্রাকৃতিক ভারসাম্যে ভূমি, নদী, তার দু’পাড়ের গাছপালা, নদীর বুকের জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ সবাই গুরুত্বপূর্ণ। নদীকে জানতে হলে কাউকেই বাদ দেওয়া যায় না। পাহাড়ি অঞ্চলে গাছপালা কেটে সাফ করে মানুষ প্রকৃতিকে যে আঘাত করছে, নদী উপত্যকার নিচু অংশে তার পরিণাম ও ব্যাপকতা দেখা দিচ্ছে। নদীর প্লাবনভূমি বা সমভূমিতে ক্রমাগত মানুষ গড়ে তুলছে ঘনবসতি, রাস্তা ও রেলপথ। নদীশাসন-এর নামে তার স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করে গড়ছে বড় বাঁধ। এতে নদীস্বাস্থ্য ক্রমশ বেহাল হয়ে নদীর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে।
ভারতীয় নদীগুলির স্বাস্থ্য রক্ষা ও জল ব্যবহারের দায়দায়িত্ব
ভারতীয় উপমহাদেশে সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র বাদে উত্তরাঞ্চলের বাকি সব নদীরই সৃষ্টি হিমালয় জলবিভাজিকার দক্ষিণে। হিমালয় পেরিয়ে উত্তর দিকে তিব্বত-এ (চিন-এ) সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্রের সৃষ্টি। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটান এই পাঁচটি রাষ্ট্র হিমালয়ের দক্ষিণ দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্গত। এসব রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু-র মূলধারা এবং তাদের উপনদী-শাখানদী। ফলে এসব আন্তর্জাতিক নদীগুলির স্বাস্থ্য রক্ষা ও জল ব্যবহারের দায়দায়িত্ব সবকটি রাষ্ট্রের।
আবার গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র-এর আন্তর্জাতিক অববাহিকার বাইরে মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের সমস্ত নদীর অববাহিকার বিস্তার দেশের মধ্যেই। এই নদীগুলি নানান রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। তাই এদের রক্ষণাবেক্ষণ ও জল ব্যবহারের দায়দায়িত্ব কোন একটি রাজ্যের নয়। এখানে বলার, উভয় ক্ষেত্রেই সকলের জলের চাহিদার কথা মাথায় রেখে নদীর জল ব্যবহারের কথা ভাবতে হবে।
নদী তুমি কার?
নদী তুমি কার?-– এ জিজ্ঞাসা কেবল সাম্প্রতিক কাল বা সাম্প্রতিক অতীতের নয়। ইতিহাস জানাচ্ছে, নদীর জলের দাবিদার কে বা কারা, এ নিয়ে সশস্ত্র বিবাদ দেখা গিয়েছিল ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বে পশ্চিম এশিয়ায় প্রাচীন সুমেরিয়া দেশে উম্মা এবং লাগাশ এই দুটি শহরের জলবণ্টন এবং সেচ-সেবিত এলাকা নিয়ে। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সশস্ত্র এই বিবাদটি চলেছিল প্রায় একশো বছর। উল্লেখ্য, পৃথিবীজুড়ে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৬৩৪টি জল নিয়ে বিবাদের ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক এই জলসম্পদ নিয়ে ৮০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৩৬০০-এরও বেশি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে।
অতীতে ধারণা ছিল নদী যখন যে রাজ্য বা রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে বয়ে যায়, নদীর ওপর তারই একচ্ছত্র অধিকার জন্মায়। বেশিরভাগ নদী-বিবাদের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চলে জলের চাহিদার কথা মাথায় না রেখে কেবল নদীর উচ্চগতিতে ও মধ্যগতিতে জলের যথেচ্ছ ব্যবহার বা অপব্যবহার। বর্তমানে এমন ধারণা থেকে মানুষ সরে এসেছে। নদীর মতো এক অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদের নাব্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে নদীর জলের ব্যবহারের বিষয়টি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। যে সকল নদী একাধিক রাষ্ট্রীয় সীমানা পেরিয়ে প্রবাহিত, তাদের জল এবং নদীর জলের সাথে সংযুক্ত ভৌমজলের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার সম্পর্কিত এক নির্দেশিকা গৃহীত হয় ইন্টারন্যাশনাল ল অ্যাসোসিয়েশন-এর ৫২তম অধিবেশনে ফিনল্যান্ড এর হেলসিংকি শহরে ১৯৬৬ সালের অগাস্ট মাসে। এটি ‘হেলসিংকি বিধি’ নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে জাতিপুঞ্জের ১৯৯৭ সালের ‘কনভেনশন অন নন নেভিগেশনাল ইউসেজ অফ ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস’ এক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক নিয়ম। একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে নদীর জলের ভাগাভাগির বিষয়ে এই নিয়মটি দুটি প্রধান নীতির ওপর জোর দেয়, (১) ন্যায়সঙ্গত এবং যুক্তিযুক্ত ব্যবহার এবং (২) পড়শি রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না করার বাধ্যবাধকতা।
নদীর জল ব্যবহার – এক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ
সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীর জল ব্যবহারের বিষয়টি সমস্ত রকম সংবাদমাধ্যমে আলোচনার শীর্ষে এসেছে। ভারতের নদীগুলির নাব্যতা ও তার জল ব্যবহারের প্রশ্নে দু’রকম সমস্যা দেখা যায়। প্রথমটি আন্তঃরাষ্ট্রীয়, দ্বিতীয়টি আন্তঃরাজ্য। সিন্ধু এবং গঙ্গা ও পদ্মা নদীর বেলায় পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানে খানিকটা সুরাহা হয়েছে। আর ঠিকঠাক বোঝাপড়ার অভাবে তিস্তা নদীর জল ব্যবহার প্রশ্নে সমস্যা যেন আর কাটতেই চায় না। আসলে সত্যটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সীমার দু’পাশে দু’টি ব্যারেজ নদীর সামগ্রিক সর্বনাশই ডেকে আনছে।
১৯৪৭ সালের দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা কেবল মানুষকে ভাগ করেনি, প্রাকৃতিক সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রেও ভাঙন সূচিত করে। দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের মধ্যে বয়ে যাওয়া নদীর জল বণ্টনের সুষ্ঠু নীতি কী হবে, সে বিষয়টি প্রায় অনালোচিত থেকে যায়। ফলত সম্প্রতি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে তিস্তা নদীর জলবণ্টন নিয়ে এক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্যের ২৯ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। তিস্তা-র আহরণ ক্ষেত্রের ১৬.৫ শতাংশ বাংলাদেশের অন্তর্গত। প্রসঙ্গত এখানে বলার, ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ফরাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে গঙ্গা নদীর জলবণ্টন সংক্রান্ত স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ ফুরোচ্ছে আগামী ২০২৬ সালে। তার পরের বিষয়টি কিন্তু যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ, ফরাক্কা ব্যারেজে উপকারের থেকে অপকার বেশি হচ্ছে বলে ২০১৬ সালে বিহার রাজ্য থেকে দাবি করা হয়েছিল এই ব্যারেজ তুলে দেওয়ার জন্য।
ভারতের মতো বিশাল দেশে একাধিক রাজ্যের মধ্য দিয়ে অনেক নদী বইছে। স্বাভাবিক কারণেই নদীশাসন এবং নদীর জল ব্যবহারে কোন রাজ্যের দাবি এড়ানোর চেষ্টায় দু’টি রাজ্যের মধ্যে বিবাদ ও সংঘর্ষের উদাহরণও ভারতে রয়েছে। কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর মধ্যে কাবেরী নদীর জলবণ্টন নিয়ে যে কলহ ও দাঙ্গা দেখা গেছে, তা উচ্চ বিচারালয় থেকে অসংখ্য কমিশন গঠন করে মেটানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণের রাজনীতি আজও কৃষ্ণা, কাবেরী-র জলবণ্টন সমস্যা নিয়ে মাঝে মাঝে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু কখনোই নদীগুলির স্বাস্থ্য নিয়ে বিশেষ কোন বৈজ্ঞানিক বা ভৌগোলিক বিশ্লেষণ করা হল না, যার থেকে প্রয়োজনভিত্তিক সুচারু পরিকল্পনা তৈরি করা যায়।
উত্তর ভারতে গঙ্গা-যমুনার জলবণ্টন নীতি প্রায় এক চিরকালীন সমস্যার মুখোমুখি। বহু পরিকল্পনা হয়েছে, কমিশন হয়েছে, কিন্তু আজও বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধ অব্যাহত। যমুনা-র জলবণ্টন নীতি নিয়ে দিল্লি ও হরিয়ানা-র মধ্যে আইনি লড়াই শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিচারালয়ে পৌঁছে যায়। ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে হরিয়ানা সরকার বাধ্য হয় দিল্লি-কে জল সরবরাহ করতে। যমুনা নদীকে নির্মল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। গঙ্গা-র দূষণমুক্তির পরিকল্পনা শতাব্দীর শেষ পর্বে আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু যমুনা বা গঙ্গা-র জলকে নির্মল করার পরিকল্পনার চরম ব্যর্থতা আজ সর্বজনবিদিত। কোন রাজ্যের সামান্যতম উদ্যোগ নেই নদীর জলরাশি থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার, কিন্তু জলের ভাগাভাগিতে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হতে কেউ পিছপা নয়।
নর্মদা নদীর জলের ভাগাভাগি নিয়েও অনেক রাজনৈতিক টানাপোড়েন হয়েছে। পড়শি রাজ্যগুলোর মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নর্মদা-র সমস্যার আজও সমাধান হয়নি। নর্মদা-র জলের ভাগাভাগিতে হাজার হাজার আদিবাসী মানুষের জমি জলের তলায় তলিয়ে গেছে।
১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত নদী বিশেষজ্ঞ সতীশচন্দ্র মজুমদার ‘রিভার্স অফ বেঙ্গল ডেল্টা’ নামে যে বক্তৃতা করেন, তার এক অংশ এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন- “আলো ও হাওয়ার মতো যখন সব প্রাকৃতিক সম্পদ অসীম নয়, যেমন নদীর জল, কোন বিশেষ রাজ্য বা প্রদেশকে তার ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগে এই সম্পদ ব্যবহারের একচ্ছত্র অধিকার দেওয়া যায় না। এই সম্পদ ব্যবহারের সুবিধা সেই নদী-বিধৌত সব রাজ্যগুলির মধ্যে তাদের চাহিদা মতো ন্যায্যভাবে বণ্টন করতে হবে। নদী উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে সেচের জন্য অত্যধিক জল ব্যবহারে নিম্মাঞ্চলে জল সরবরাহ কমে যায়।”
আন্তঃরাজ্য নদী-বিবাদ এড়াতে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বেশ কিছু নদীর সংযোগের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে রাজ্যগুলির মতামত না নিয়েই। এযাবৎ তিরিশটি নদী-সংযুক্তি প্রকল্প চিহ্নিত করা হলেও মাত্র একটি (মধ্যপ্রদেশ-এ কেন-বেতোয়া) সংযুক্তি-প্রকল্প চালু হয়েছে। এই প্রকল্পটি ইতিমধ্যে যথেষ্ট সমালোচিত। কারণ এটি রূপায়িত হলে, প্রায় নয় হাজার হেক্টর জমি জলে ডুবে যাবে, যার মধ্যে ‘পান্না বাঘ সংরক্ষণ কেন্দ্র’-এর বাঘ ও শকুনের বাসভূমি রয়েছে। আন্তঃরাজ্য নদীর জলের সুষ্ঠু বণ্টনের জন্য শ্রীমজুমদার নদীর উপত্যকার রাজ্যগুলোকে নিয়ে নদী কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন এই বক্তৃতায়। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পঁচাত্তর বছর পরেও তা আমরা করে উঠতে পেরেছি কিনা জানা নেই।
বেহাল নদীস্বাস্থ্য ও মিঠাজলের চাহিদা
স্বাধীনতা-উত্তর কালে বহুমুখী নদী পরিকল্পনায় নদীতে বড় বাঁধ দিয়ে বিশাল জলাধার বানিয়ে মানুষের রোজকার ব্যবহার্য জলের চাহিদা মেটাতে নদীতে জলপ্রবাহ বজায় রাখার যে একপেশে চিন্তাভাবনা আমরা করেছিলাম, তাতে নদীস্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা ছিল নামমাত্র। উন্নয়ন ও দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশ সমস্যার বিষয়টি খেয়াল রেখে মানুষ ও নদীর মধ্যে এক সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে বহুমুখী নদী পরিকল্পনার কার্যকারিতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে। আজও যে এমন চিন্তাভাবনা থেকে আমরা সরে আসতে পেরেছি, তা-ও নয়। স্বাধীনতার পর দেশের সর্বত্র জনসংখ্যা বেড়েছে। শিল্প-কৃষির বিস্তার ঘটেছে। ফলত পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মিঠাজলের চাহিদা। অথচ প্রাকৃতিক নিয়মেই জলের বণ্টন সর্বত্র সমান নয়। এটি জানা সত্ত্বেও আগুপিছু মাথায় না রেখে সীমিত এই প্রাকৃতিক সম্পদকে আমরা যথেচ্ছ ব্যবহার করেই চলেছি।
স্বাধীন ভারতে প্রায় কোনরকম পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়াই বিভিন্ন নদীর উপর বড় বাঁধ দিয়ে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নদীশাসন করতে চেয়েছে, আর নদী তার ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে বারবার মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদ ভারতবর্ষের বিভিন্ন নদীগুলির দূষণ নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছে। কিন্তু সেই সমীক্ষায় নদীর সামগ্রিক গতিময় স্বাস্থ্য বা তার জীববৈচিত্র্যের কী অবস্থা, তার বিশ্লেষণ অধরা থেকে গেছে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রতিবেদন থেকে একটি সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ভারতবর্ষের সমস্ত নদী মারাত্মক ভাবে দূষণে ভারাক্রান্ত এবং নদীগুলির নাব্যতা যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের নদীগুলিকে দূষণমুক্ত করার জন্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও তার পরিণতিও অত্যন্ত করুণ। ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ পশ্চিমবঙ্গের নদীগুলির তৎকালীন অবস্থা সংক্রান্ত একটি সমীক্ষার আয়োজন করেছিল। কিন্তু তার পর থেকে অনেকটা সময় কেটে গেলেও নতুন কোন সমীক্ষা হয়েছে বলে শোনা যায় না। অদ্ভুত এক রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার জন্য ভারতবর্ষের নদী-সম্পদের যথাযথ তথ্যভিত্তিক মানচিত্র আজও তৈরি হয়নি। স্বাধীন ভারতের অন্যতম দায়বদ্ধতা হওয়া উচিত ছিল নদীগুলির বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা, কারণ নদীস্বাস্থ্য-র ওপরেই ভারতবর্ষের কৃষিব্যবস্থা নির্ভরশীল। কৃষিনির্ভর ভারতীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি নদীর জল। অথচ নদী এবং বিস্তৃত জলাভূমি রাষ্ট্রীয় ভাবনায় আজও ব্রাত্য থেকে গেছে।
কথা শেষের কথা
নদী তুমি কার অর্থাৎ নদীর জলের দাবিদার কে বা কারা, এই প্রসঙ্গে ইতি টানার আগে ভারতের বিশিষ্ট সেচ-বিশেষজ্ঞ কে এল রাও-এর এক উক্তির কথা বলতেই হয়। রাও বলেছিলেন যে, নদীর জলে দাবিদার যে মানুষ একাই নয়, তা সে প্রায় ভুলেই গেছে। এই জলের দাবিদার মাছ, অন্যান্য জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। এরাই আদি দাবিদার। কিন্তু পৃথিবীতে মানুষ এসে তার নিজের দাবিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। অন্যরা সয়েছে অপূরণীয় ক্ষতি। তাই কোন নদী-অববাহিকার পূর্ণাঙ্গ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নদীর চরিত্র ও তার বাস্তুতান্ত্রিক সমীক্ষা ছাড়া কখনোই হতে পারে না।
একুশ শতককে ‘পরিবেশ শতক’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিবেশ সমস্যার অন্যতম আলোচ্য হল মিঠাজলের চাহিদা পূরণ। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ স্বীকার করে নিয়েছে যে, এই মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বে দু’শো কোটি মানুষ জলের অভাবে মৃত্যুর অপেক্ষায়। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় নদীগুলির নাভিঃশ্বাস উঠেছে। পৃথিবীতে যে দশটি নদী আগামী দিনে অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি, তাদের মধ্যে দু’টি নদী ভারতবর্ষের — গঙ্গা এবং সিন্ধু। কেন্দ্রীয় জল সম্পদ মন্ত্রক-এর তথ্য জানাচ্ছে, ২০২১ সালে ভারতে মাথাপিছু জলের জোগান ছিল ১৪৮৬ বর্গমিটার। ২০৩১ সালে এটি মাথাপিছু কমে দাঁড়াবে ১৩৬৭ বর্গমিটার। উল্লেখ্য, মাথাপিছু জলের জোগান ১৭০০ বর্গমিটারের কম হলে তা জলসংকট হিসেবে ধরা হয়। সম্প্রতি ‘মুডিজ রেটিংস’ প্রতিবেদনে আভাস দেওয়া হয়েছে যে, ভারতের অর্থনীতি এই ২০২৪ সালে অন্যান্য জি-২০ দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি ৬.৫ শতাংশ হারে বাড়বে। ২০২২ সালে যেখানে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ শহরে বাস করত, আগামী দিনে আরও মানুষ শহরমুখো হবে। আর এসবের নিট ফল হল জলের চাহিদা বৃদ্ধি। আমাদের ভুলে গেলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না যে, এরই মধ্যে বেঙ্গালুরু, দিল্লি, এমনকি মুম্বাই-তেও ভয়ানক জলকষ্ট দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে ভারতবাসীরা জল নিয়ে তীব্র লড়াই দেখবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
ভারতের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডক্টর মেঘনাদ সাহা বহুদিন আগেই দেশের নদীস্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে সুচিন্তিত বিজ্ঞানধর্মী নদী পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। কে এল রাও-ও নদীর উন্নয়নের জন্য নদী-অববাহিকা ভিত্তিক কমিশন গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন। তিনি চেতাবনি দিয়েছিলেন- ‘ডু নট ডিস্টার্ব দ্য বেসিন।’ কিন্তু আমরা এসব কথায় কান দিইনি। ক্রমাগত নদীর স্বাস্থ্যহানি করেছি। ভুলেই গিয়েছি রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণী – ‘প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছুদূর পর্যন্ত সয়, তারপরে আসে বিনাশের পালা।’
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় (পরিবেশ ও সমাজকর্মী )
চলভাষ – ৮৪২০৭৬২৫১৭
ই-মেল – biswajit.envlaw@gmail.com
এবং
রাহুল রায়, শিক্ষক ও পরিবেশ কর্মী,
চলভাষ- ৮৬১৭৭৪৫৩৪০,
ই-মেইল: rayrahul2263@yahoo.co.in
Disclaimer:
- The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
- The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s).
- All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
- No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).