You are currently viewing দেবভূমিতে নদীর নির্মলতা – একটি মৌলিক প্রশ্ন

দেবভূমিতে নদীর নির্মলতা – একটি মৌলিক প্রশ্ন

Share this post

সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে নানান সমাহারে আমরা বেঁচে থাকি । প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষ ফুলের দেশ, নদীর দেশ । আর এই ভারতবর্ষের মাটিতেই জন্ম নিয়েছে বেশ কয়েকটি ধর্ম । দীর্ঘকাল ধরে সমস্ত ধর্মই এখানে পাশাপাশি গড়ে উঠেছে । বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি দীর্ঘকাল ধরে থেকেছেন । এর ফলস্বরূপ সমগ্র দেশ জুড়েই গড়ে উঠেছে মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার সহ আরো বহু ধরনের ধর্মীয় পীঠস্থান ।

সাম্প্রতিক কালে অন্তত কয়েকটি পীঠস্থান নিয়ে ক্রমাগত কাগজে প্রতিবেদন বেরোচ্ছে এবং অনেকেই সেসব স্থানে ভ্রমণে যাচ্ছেন । একটি হচ্ছে অযোধ্যায় সরযূ নদীর ধারে রাম মন্দির এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে গঙ্গা নদীর ধারে বেনারসের মন্দির । এ’দুটি নতুন কলেবরে সেজে উঠছে । ফলে ভারতবর্ষের অনেকেই সেখানে মন্দির দর্শনের জন্য যাচ্ছেন । কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে, এই দুটি জায়গাতেই মন্দিরের কাছে দুটি অত্যন্ত সুপরিচিত নদী রয়েছে । একটি বেনারসের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা, যেটি ভারতবর্ষের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে সঞ্জীবিত রাখে । দ্বিতীয়টি অযোধ্যা, যেখানে রাম মন্দির গড়ে উঠছে, তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শতাব্দী-প্রাচীন সরযূ নদী । এখন এই নদী দুটির শারীরিক অবস্থা কীরকম ? এক কথায় বলতে গেলে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাংশের একটি-দুটি নদী ছাড়া আর বাকি সমস্ত নদীই দূষণে ভারাক্রান্ত । যে উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ মন্দির তৈরি হচ্ছে, সেই উদ্দীপনার কিছু অংশ কি আমরা দেবভূমিতে এই বহতা নদীর সংরক্ষণের জন্য দেখতে পাই ?

বেনারসের গঙ্গা যে দূষণে আক্রান্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । যে কোন মানুষ খালি চোখে তাকালেই দেখতে পাবে যে বেনারসের গঙ্গা ভয়াবহ দূষণে আক্রান্ত । একই অবস্থা সরযূ নদীরও । সরযূর কথা বারবার উঠছে এই কারণে, যে নদী রামায়ণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে, সেখানে আশেপাশের অঞ্চল থেকে ক্রমাগত পৌর বর্জ্য ও দূষিত জল এসে পড়ছে । বহু বিজ্ঞানীর দ্বারাই এটি পরীক্ষিত সত্য । কিন্তু সরযূ নদীর নির্মলতা নিয়ে আমরা কেউই ভাবছি না । সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে বিভিন্ন মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বার, গির্জা ইত্যাদি নিয়ে যে ধর্মীয় উত্তেজনা আজ আমরা দেখছি, সেই উন্মাদনার সামান্য অংশ কি আমরা নদীর নির্মলতা রক্ষার জন্য করতে পারি না ! সময় চলে যায়, নদী দূষিত হয় । একটার পর একটা নদী পরিকল্পনা হয় — গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান, যমুনা অ্যাকশন প্ল্যান সহ আরো অনেক নদী পরিকল্পনা, কিন্তু এই নদী পরিকল্পনা সার্থক কতটা হয়েছে তা আমরা তো কখনো ভেবে দেখিনি ।

পশ্চিমবঙ্গের বুকেও আমরা দেখতে পাচ্ছি নানা ধরনের মন্দির মসজিদ সেজে উঠছে । দক্ষিণেশ্বরে মানুষের যাতায়াতের জন্য সুন্দর বন্দোবস্ত করা হয়েছে । কিন্তু দক্ষিণেশ্বরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার দূষিত অবস্থাটা আমরা কি জানি না ! দিঘায় পুরীর মন্দিরের আদলে গড়ে উঠছে একটি বড় জগন্নাথ মন্দির । কিন্তু দিঘার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অ-ব্যবস্থার কথা আমাদের অজানা নয় । দিঘার সমুদ্র উপকূলে আইন ভেঙ্গে যেসব হোটেল হয়েছে, যেভাবে বর্জ্য ফেলে দেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমরা ক’জন খোঁজ রাখি ? খোঁজ রাখলেও আমরা সেসব দিকে চোখ ফেরাতে চাই না, তার কারণ চোখ ফেরালেই বোঝা যাবে যে পরিবেশ নিয়ে আমরা মোটেও সচেতন হইনি ।

ভারতবর্ষের বড় বড় অনেক নদীর উৎসস্থল হিমালয় । হিমালয়কে ভেঙে তছনছ করে ফেলা হচ্ছে । হিমালয় যদি না বাঁচে নদী বাঁচবে না । হিমালয় থেকে উৎপন্ন গঙ্গা-যমুনা সহ নানা নদীর উপর ভারতবর্ষের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ নির্ভরশীল । গঙ্গা নদী ভারতবর্ষের পাঁচটি রাজ্যের উপর দিয়ে বয়ে গেছে । কিন্তু আমরা এদিকে নজর দিই না । উত্তরাখণ্ডের দেবভূমি আজ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত । সেখানে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে রাস্তা তৈরি হচ্ছে । কোন প্রয়োজনীয়তার কথা না ভেবেই সুড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছে পাহাড় কেটে । এর ফলে সেখানে নানান রকমের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে । পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের পাহাড়েও নদীগুলির মৃতপ্রায় অবস্থা আমরা দেখতে পাচ্ছি । ভারতবর্ষের সমস্ত রাজ্যে এই একই চেহারা । নদীর দিকে আমরা কেউই ফিরে তাকাচ্ছি না ।

নানান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নদী নিয়ে সচেতনতা প্রচার করছে, নদীকে ঘিরে তারা আন্দোলন করছে । পশ্চিমবঙ্গের বুকে জলঙ্গী নদী, সরস্বতী নদী, ইছামতি নদী এসব নিয়ে আন্দোলন, পদযাত্রা হচ্ছে । বহু সন্ন্যাসী নদী বাঁচানোর জন্য অনশন করছেন । এসব ঠিকই আছে, কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আমরা একটা জিনিস তো বলতেই পারি যে, সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে নদীর পাশ দিয়ে বা নদীর উপর দিয়ে যত জাতীয় সড়ক ও রাজ্য সড়ক আছে, যত রেলপথ গেছে, সেগুলির আমরা প্রত্যেকটির যদি নাম লিখে রাখি, সেই নদীগুলির দিকে ফিরে তাকিয়ে তাকে বাঁচানোর সচেতনতার কথা যদি দু’চারটি বাক্যে লিখে রাখি, তা নদী বাঁচানোর এক প্রাথমিক বড় প্রয়াস হবে । এর জন্য অতি সামান্যই খরচা হবে । সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে যত মন্দির-মসজিদ তৈরি হচ্ছে, সেই খরচার ১০০ ভাগের এক ভাগও এতে খরচ হবে না । আর এই কাজটির মধ্যে দিয়ে সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে নদীর দিকে ফিরে তাকানোর, তাকে বাঁচানোর বার্তা কিন্তু সহজেই ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে ।

আজ যাঁরা নদী নিয়ে কাজ করছেন, যাঁরা পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের কাছে আমাদের অনুরোধ যে, আপনারা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখুন, আমরাও লিখছি, যাতে নদীর উপর তৈরি হওয়া প্রত্যেকটি রেল ব্রিজের কাছে নদীর নাম লেখা হয়, প্রত্যেকটি জাতীয় সড়কের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর নাম লেখা হয় এবং নদীর দিকে ফিরে তাকানোর বার্তা যেন সেখানে দেওয়া থাকে । রাজ্য ও কেন্দ্রস্তরে এ লেখা হোক । আজ ভারতবর্ষের বুকে প্রতিটি ধর্মীয় আন্দোলন যে গতি নিয়ে এগোচ্ছে, সেভাবেই এই বার্তার মধ্যে দিয়ে বহতা নদীর দূষণমুক্তির এই আন্দোলন এগিয়ে চলুক ।

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় (পরিবেশ ও সমাজকর্মী )
চলভাষ – ৮৪২০৭৬২৫১৭
ই-মেল – biswajit.envlaw@gmail.com

Disclaimer:

  • The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
  • The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s). 
  • All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
  • No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).

Share this post

Leave a Reply