সাম্প্রতিককালে ভারতবর্ষের পার্লামেন্টে একটি চিত্রনাট্য অনুষ্ঠিত হল। কয়েকটি যুবক কিছু দাবিকে সামনে রেখে শাসকদলের এক সাংসদের অনুমোদন পত্র নিয়ে সংসদ ভবনে ঢুকল। পায়ের তলায় লুকিয়ে রাখা ধোঁয়া সৃষ্টিকারী বিভিন্ন সামগ্রী সংসদ ভবনে ছড়িয়ে দিয়ে আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্টি করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা গ্রেফতারও হল। বিষয়টি পুলিশের তদন্তে রয়েছে। এই ঘটনার পেছনে কারা রয়েছে মদতদাতা, তা ভারতের শাসনব্যবস্থা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।
চিত্রনাট্যটি এখানেই শেষ হল না। এরপরে এই জনপ্রতিনিধিদের সুরক্ষা নিয়ে বা নতুন যে সংসদ ভবন তৈরি করা হয়েছে, সেখানে জনপ্রতিনিধিরা মোটেই সুরক্ষিত নন — এই প্রসঙ্গটি তুলে শাসকদলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দাবি করা হল। এই বিবৃতি না পাওয়ায় সমস্ত বিরোধী দল প্রতিবাদস্বরূপ একযোগে পার্লামেন্ট বয়কট করে সংসদ ভবনের বাইরে চলে এলেন। এই ঘটনায় নজিরবিহীনভাবে একশোরও বেশি সাংসদকে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ থেকে সাসপেন্ড করা হল। এটা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে হাজার হাজার শব্দ খরচ করা হল। এমনটি মনে হল যে, সংসদ ভবনের এই ঘটনায় ভারতবর্ষের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। অতীতেও একবার এ ধরনের সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ ঘটেছিল। দীর্ঘ সময় ধরে সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে অনেকদিন ধরে কথাবার্তা চলছে। সাধারণ মানুষও এই নিয়ে পাড়ার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অফিস-কাছারি-আদালত পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত থেকেছেন ।
এর পরের চিত্রনাট্যটি আরো চমৎকার। বিরোধী সদস্যরা সবাই বেরিয়ে যাওয়ায় কার্যত বিরোধী-শূন্য সংসদে কতগুলি বিল পাশ করা হল। গণতন্ত্র-ধ্বংসকারী এইসব বিলের অন্যতমটি হল নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণরূপে শাসকদলের কবজায় আনা। অতীতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার কে হবেন সে ব্যাপারে মতদানের জন্য ভারতের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে রাখা হত। এখন তাঁকে বাদ দিয়ে দেওয়া হল। অর্থাৎ মানুষের বাক্ স্বাধীনতা, মানুষের সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত হবার জন্য প্রশাসনের দেখভালের যে ক্ষমতা, এ সমস্ত কিছুকেই বিভিন্ন বিলের মাধ্যমে একেবারে হরণ করা হল। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সংবিধানের সূত্র ধরে ভারতে যে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বি আর আম্বেদকর রচিত সংবিধানের মাধ্যমে, তার অনেকটাই অবসান ঘটল।
চিত্রনাট্যটি অন্ততপক্ষে এখানে শেষ হলেই ভাল হত। কিন্তু প্রশ্ন উঠল যে, এতদিন ধরে পার্লামেন্ট বয়কট করলেন বিরোধীরা, কিন্তু এর থেকে বড় কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ কি দেশে আর নেই, যার জন্য মাঝে মাঝে মহামান্য এই সদস্যদের পার্লামেন্ট বয়কট করে অচল করার প্রয়োজন হতে পারতো ? বিগত পাঁচ বা দশ বছরের মধ্যে এটাই কি অন্যতম বড় কারণ হয়ে দেখা দিল যার জন্য সংসদ বয়কট করতে হল ? একবার ভেবেও কি দেখা হল যে, এই বয়কট করার ফাঁক দিয়ে গণতন্ত্র-ধ্বংসকারী বিভিন্ন বিল পাশ হয়ে গেল সংসদে ?
* এবার যদি আমরা ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক দিকের কথা ভাবি, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের জীবনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব তাদের জীবন সুরক্ষিত নয়, তাদের মানসম্মান সুরক্ষিত নয়, তাদের জীবিকা সুরক্ষিত নয়। ভারতবর্ষে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দু’কোটি। এই শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধের জন্য যে সমস্ত আন্ত:রাজ্য আইন তৈরি করা হয়েছিল, তা ভারতবর্ষের প্রায় কোন রাজ্যেই কার্যকরী হয়নি। করোনা কালে ভারতবর্ষ যখন লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখল, তখন কিছুদিন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তা নিয়ে শোরগোল হল, তারপর সব স্তব্ধ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বামপন্থী দল, জনদরদি দল, উদারপন্থী দল সবাই রাজত্ব করেছে। কিন্তু কখনোই কোথাও পরিযায়ী শ্রমিকদের এই আইনকে কার্যকরী করা হল না। ফলে এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, তারা মুখে যা বলে, এই রাজনৈতিক দলগুলি কখনোই তা কার্যে পরিণত করে না। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে একটা দিনের জন্যও কোনও রাজনৈতিক দল পার্লামেন্ট বয়কট করেনি। কোনরকম অনশনে সাংসদরা বসলেন না। তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে, পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষাদান জনপ্রতিনিতিদের সুরক্ষাদানের তুলনায় মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।
* এই প্রান্তিক মানুষরা কর্মজীবনের শেষে পেনশন যেটা পান, সেটি সর্বনিম্ন ১০০০ টাকা। এটা সবাই স্বীকার করবেন যে, আজকের দিনে এক হাজার টাকায় তিন চার জনের একটি পরিবার কিছুতেই চলতে পারে না। এরা অত্যন্ত দুর্দশার মধ্যে বেঁচে আছে। বিভিন্ন নির্বাচনের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁদের ইশতাহারে এদের পেনশন বাড়ানোর কথা বলেছেন । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নির্বাচনী অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও পেনশন একটুও বাড়ল না। শ্রমজীবী মানুষদের তরফ থেকে ন্যূনতম যে ৫ হাজার টাকা মাসিক পেনশনের দাবি, সেটা আজও মেনে নেওয়া হল না। এখানেই শেষ নয়। মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন ‘সমকাজে সমবেতন’ । করোনা কালে আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক যে সমস্ত শ্রমিক ছিলেন, তাঁদের ছাঁটাই করে দেওয়া হল। এঁরা অনেকেই আজও কাজ ফিরে পাননি এবং ফিরে পাবেনও না হয়তো। মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের সমকাজে সমবেতনের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এঁদের জীবনের অন্ধকার কাটল না। কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার — কোথাও এই নির্দেশ মানা হল না। শাসক ও বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের কারোরই মনে হল না যে, এটি নিয়ে সংসদে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। মাননীয় সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করার জন্য পার্লামেন্টে একটা বিক্ষোভ দেখানো দরকার। এখানেই বোঝা যাচ্ছে যে, সাধারণ মানুষের সুরক্ষা নয়, এঁরা কেবল নিজেদের সুরক্ষার কথাই ভাবেন। সেখানে পান থেকে চুন খসলেই তাঁরা পার্লামেন্ট বয়কট করে বিভিন্ন রকম চিত্রনাট্য তৈরি করেন।
* কেবল সমকাজে সমবেতনই নয়, এর পরেও অনেক ঘটনা আছে। প্রবীণ নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের একটি আইন রয়েছে। কিন্তু কেউ কি বলতে পারবেন ভারতবর্ষের প্রতিটি জেলায় একটি করে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে সরকারি উদ্যোগে ? আইনেই বলা রয়েছে যে, সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি জেলায় একটি করে বৃদ্ধাশ্রম থাকবে। এই বৃদ্ধাশ্রমে কম করে ১৫০ জন অতি দরিদ্র মানুষের থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। ভারতবর্ষে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% হলেন প্রবীণ নাগরিক।অথচ এঁদের জন্য নির্দিষ্ট আইন থাকা সত্ত্বেও তা কার্যকরী হল না। আরো আশ্চর্যের কথা এই যে, কোন জনপ্রতিনিধিকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, আপনি কি জানেন প্রবীণ নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য, পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য দেশে একটি আইন রয়েছে? দেখা যাবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা চুপ করে প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে যাবেন।
* আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ কখনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে লুণ্ঠিত হচ্ছে, কখনো বা রাষ্ট্রের সরাসরি মদতে বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা তা লুন্ঠন করছে। কর্পোরেটদের লুন্ঠনের সুবিধার্থে কেন্দ্রীয় সরকার বারবার আইনের পরিবর্তন আনছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং পরিবেশ দপ্তরগুলিকে অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে। এই চিত্র ভারতের সর্বত্র। আমাদের রাজ্য সহ দেশের বিভিন্ন অংশে জলাভূমি আক্রান্ত, নদী আক্রান্ত, কিন্তু কোন আইনই মানা হচ্ছে না। সবাই জানে যে, এটা নিয়ে সংসদে কোনদিনই কোন আলোচনা হয় না। যে সমস্ত কর্পোরেট প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছে বা অবাধে লুঠ করছে, তাদের কাছে কোথাও বোধকরি রাজনৈতিক দলগুলি বাঁধা আছে।
* ভারতবর্ষ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। সমস্ত ভারতের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে কৃষকের ওপর। বিগত ১৫-২০ বছর ধরে বহু জায়গায় ব্যাপক পরিমাণে কৃষকরা আত্মহত্যা করেছে। তার পরিসংখ্যান নিয়ে বা এঁদের দুর্দশার জন্য কোনও অশ্রুজল ব্যয় করে কোন সাংসদ সংসদভবনে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে বসেছেন বলে আমাদের জানা নেই। অথচ এই কৃষকেরা অর্ধাহারে বা অনাহারে থেকে ফসল না ফলালে আমাদের মুখে অন্ন জোটে না। যাঁরা আমাদের অন্নদাতা, তাঁদের জন্য আমাদের কোনো ভাবনা নেই। ভাবনা নেই নদী-সমুদ্রের ধারে বসবাসকারী জলের ভাসমান সন্তানদের প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে চরম দুর্দশার মধ্যে দিন কাটানো নিয়ে। আমাদের কোনো ভাবনা নেই যে কিভাবে কর্পোরেটদের স্বার্থে বন কেটে সাফ করা হচ্ছে। আরো বলার যে, বহু শ্রমজীবী মানুষ সিলিকোসিস সহ নানান পেশাগত রোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু সে কথা কোন সাংসদই ভাবেন না। কারণ তাঁদের ভাবার অবসর কই ? তাঁরা নিজেদের সুরক্ষা ও ক্রমবর্ধমান সম্পত্তির স্ফীতি নিয়ে ব্যস্ত।
* সর্বশেষে বলা প্রয়োজন যে, বর্তমানে আমাদের দেশে শিশু-মহিলা সহ বিভিন্ন প্রান্তিক মানুষের কোন নিরাপত্তা নেই। অন্যান্য রাজ্যে জীবিকার খোঁজে গিয়ে তাঁরা হারিয়ে পর্যন্ত যাচ্ছেন । এঁদের নিরাপত্তা দেবার কেউ নেই। হারিয়ে গেলে এঁদের পরিবারের লোকজন কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেন। বিভিন্ন থানায় যান। থানা বলে দেয় এ ঘটনা আমাদের এখানে ঘটেনি। তাই কিছু করা যাবে না। ধীরে ধীরে সবাই ঘটনাটি ভুলে যান । মানুষগুলো চিরতরে হারিয়ে যান । এমন করে দেশের কত মানুষ হারিয়ে গেল, কত মহিলা পাচার হয়ে গেল, এমনকি মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার হয়ে যাচ্ছে, কেউ তার কোন খবর রাখে না। দেশের এই নাগরিকগুলি হারিয়ে গেলেও রাষ্ট্র কোন দায়িত্ব নেয় না, বোধহয় এরা কোন জনপ্রতিনিধি নয় বলেই। এদের ভারতের সংসদে বসার কোন অধিকার নেই, কিন্তু সংসদে জনপ্রতিনিধিদের পাঠানোর অধিকার এদের আছে। এদের পাঠানো জনপ্রতিনিধিদের সুরক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র অতি চিন্তিত, অথচ যারা পাঠাচ্ছেন, তাঁদের নিয়ে রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যথা নেই।
এবারে মৃণাল সেনের জন্মশতবার্ষিকী। ইনি একসময় রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। তাঁরই একটি চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত একটা গানকে স্মরণ করে বলতে হয়, এই নীল আকাশের নিচে বুভুক্ষু মানুষের কান্না কি তুমি কখনো শোনোনি যাদের কথা বলতেই জনপ্রতিনিধিদের সংসদে যাওয়া! সামনেই আরেকটি লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে এসব বিষয়বস্তুকে সামনে তুলে ধরে মানুষকে ভাবতে হবে যে, কোনরকম নাটকীয় চিত্রনাট্যের আবহে আমরা যেন ভুলে না যাই অতীতের এই সমস্ত ঘটনা। প্রান্তিক মানুষের সঠিক দাবিগুলিকে নিয়ে সোচ্চার হবার জন্য তাই — পথেই এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথে চেনা । কিন্তু এই পথ যদি আমরা চিনে নিতে না পারি, যদি সঠিক পথ ধরতে না পারি, তাহলে সামনে অপার অন্ধকার। আমাদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রতারণার বিরুদ্ধে এবার আমাদের পথে নামার সময় এসেছে।
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় (পরিবেশ ও সমাজকর্মী)
চলভাষ – ৮৪২০৭৬২৫১৭
ই-মেল – biswajit.envlaw@gmail.com
Disclaimer:
- The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
- The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s).
- All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
- No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).