প্রত্যেক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রশাসনের সঙ্গে নাগরিকদের নানাবিধ সমস্যা তৈরী হয় এবং যখন নাগরিকরা প্রশাসনের দ্বারা তাদের প্রয়োজনীয় সমস্যার সমাধানে সন্তুষ্ট হন না তখনই তারা বিচারবিভাগের কাছে তাদের আর্জি নিয়ে হাজির হন তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে। রাষ্ট্রের আইন বিভাগ যে আইন তৈরী করে তার কার্যকারীতা প্রশাসনিক প্রয়োগ নিয়ে কোন সমস্যা তৈরী হলে বিচারবিভাগই তার সমাধানের উদ্দ্যোগ নেন। ভারতবর্ষের সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকার বর্ণিত এবং সেই মৌলিক অধিকার প্রশাসনিক ব্যর্থতায় খণ্ডিত হলে নাগরিকরা আদালতের দ্বারস্থ হন। কেবলমাত্র হাইকোর্ট নয়, দৈনন্দিন জীবনের বহু ধরনের সমস্যা নিয়ে নাগরিকরা প্রশাসনিক ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছেও দ্বারস্থ হন শান্তি রক্ষার জন্য। বিচারবিভাগ ছাড়াও বিভিন্ন দপ্তরে মানুষের অভাব অভিযোগ দূরীকরণের জন্য আধা বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা প্রশাসনিক দপ্তরকে ন্যাস্ত করা হয়েছে। ফলত সাধারণ নাগরিক তাদের জীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জীবন জীবিকার প্রশ্নে নানাভাবে বিচারবিভাগ বা আধা বিচারবিভাগ দপ্তরের কাছে তাদের আর্জি পেশ করেন সমাধানের জন্য। প্রত্যেকেই আশা করেন তার সমস্যার সমাধান দ্রুত ও আইনমোতাবেক হবে। কিন্তু বর্তমানে সুপ্রীম কোর্ট থেকে হাইকোর্ট, হাইকোর্ট থেকে জেলা আদালত, মহকুমা আদালত সহ বিভিন্ন ট্রাইবুনালে আধা বিচারবিভাগীয় দপ্তরগুলিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের অভিযোগ জমা হয়ে রয়েছে কিন্তু সমাধান সূত্র দূর অস্ত। প্রশাসনিক অব্যবস্থা, দুর্বলতা ও পক্ষপাতিত্ব সহ নানাবিধ কারনে নাগরিকরা বাধ্য হচ্ছেন বিচার বিভাগের কাছে বা ট্রাইবুনালে বা আধা বিচারবিভাগীয় দপ্তরের কাছে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য আবেদন করতে। ভারতবর্ষে জনস্বার্থ মামলার সূত্র ধরে অসংখ্য মামলা হাইকোর্টে বা বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য প্রতিক্ষারত। সময় নদীর জলের মতো বয়ে যায় কিন্তু বিচারপ্রার্থীরা তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন কখন তিনি তার অভিযোগের ভিত্তিতে ন্যায়ের সন্ধান পাবেন। সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে যে সমস্ত মামলা ন্যায়ের সন্ধানের জন্য বিচারবিভাগের দ্বারস্থ হয়েছেন তাদের বৃহত্তর অংশ শ্রমজীবি হতদরিদ্র মানুষ বা পরিবেশ বিপর্যস্ত নাগরিক অথবা মানবাধিকার লঙ্ঘিত সমস্যাজনিত কারণে আমরা প্রত্যেকেই জানি বিলম্বিত ন্যায়বিচার, ন্যায়বিচার অস্বীকারের সামিল। একথা জানা সত্ত্বেও বিলম্বিত ন্যায়বিচার ভারতের সর্বত্র বিরাজমান। কয়েকটি উদাহরণেই প্রতীয়মান হবে কিভাবে ভারতবর্ষের শ্রমজীবি হতদরিদ্র মানুষ বিচারের আশায় কোর্টে মাথা খুঁড়ছে কিন্তু জীবিত অবস্থায় তারা হয়তো কোনদিনই ন্যায়বিচার পাবে না কারণ তাদের হয়ে বলার জন্য দামী উকিল নেই। সমস্ত দামী গালভরা উকিলই মালিকের পক্ষে, তারা মাননীয় কোর্টের কাছে দাঁড়িয়ে তাদের ব্যস্ততার কথা বলে দিন নিয়ে চলে যান ফলত বিচার থমকে দাঁড়ায়।
• চন্দননগর গোন্দলপাড়া জুট মিলের অন্তর্গত একটি প্রাইমারি স্কুল ছিল যেটি মালিকরাই চালাতেন শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানের জন্য। সেই স্কুলের মাষ্টারমশাই মুনাপ্পা সুব্বারাও অবসর নিলেও গ্র্যাচুইটি পান নি। শ্রম দপ্তর মালিককে গ্র্যাচুইটি দিতে বললেও দেয় নি, হতভাগ্য মাষ্টারমশাই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলেন ২০১৫ সালে কিন্তু প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিল না। বৃদ্ধ মাষ্টারমশাই আজ আর নেই। মালিকের টাকা বেঁচে গেল এবং মুনাপ্পা সুব্বারাও প্রশাসনিক পাফিলতিতে যে টাকা পেলেন না তার জন্য কারোর কোন অনুশোচনা নেই। কেবলমাত্র মুনাপ্পা সুব্বারাও নয়, এরকম অসংখ্য শ্রমিক হাইকোর্টে মামলা করেছেন, সেই মামলা হাইকোর্টে বস্তাবন্দী হয়ে পড়ে আছে। কোন দিন এই মামলা সূর্যের মুখ দেখবে কিনা কেউ জানে না।
• ২০১৩ সালে শব্দবাজীর প্রতিবাদ করে যে সমস্ত ব্যক্তি আক্রান্ত হন এবং মারা যান তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে মামলা হয় কিন্তু সেই মামলার আজও নিষ্পত্তি হয় নি। অতীতে শব্দবাজীর প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রথম আক্রান্ত হন দীপক দাস। তাঁকে কলকাতা হাইকোর্ট ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের উদ্যোগে শব্দ শহীদ ঘোষনা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১১ সাল পর্যন্ত এই ধরনের আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে প্রশাসন দাঁড়ালেও ২০১৩ থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়। শব্দ শহীদদের স্বার্থে জনস্বার্থ মামলা আজও হাইকোর্টে নিষ্পত্তির আশায় প্রতিক্ষারত। অথচ মদ খেয়ে মারা গেলে ক্ষতিপূরণ পায়, পূজা কমিটি সরকারী অনুদান পায়, কিন্তু পায়না সরকারী সাহায্য শব্দ শহীদরা।
• ২০১৪ সালে মিনাখায় সিলিকোশিস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা রুজু করা হয়। সেই মামলা আজও বিচারের জন্য প্রতীক্ষারত। মিনাখা গ্রাম জুড়ে মৃত্যু মিছিল অব্যাহত, কিন্তু প্রশাসনিক স্তরে বিশেষ কোন উদ্যোগ নেই আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর। এমনকি যে সমস্ত কারখানা এই মৃত্যুর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধেও প্রশাসন কোন রকম ব্যবস্থা নিল না অথচ একদা মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট সিলিকোশিস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের জন্য মালিকের বাড়ি, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সিলিকোশিসে আক্রান্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সে পরিস্থিতির আর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে না। জনস্বার্থ মামলা আজ হাইকোর্টের চত্বরে নিরুত্তর হয়ে প্রতিক্ষারত।
• ২০১৭ সালে প্রবীন নাগরিকরা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করে বললেন যে প্রবীন নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য ২০০৭ সালের যে আইন প্রণীত হয়েছে তা কার্যকারী করার জন্য প্রশাসন যোগ্য ভূমিকা পালন করুক। ২০১৭ থেকে দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে, ২০২৩ সাল শেষ হতে চলল, মাননীয় বিচারপতিরা এই মামলা শোনার জন্য কোন রকম উদ্যোগ দেখাতে পারেন নি। প্রবীন নাগরিকদের দাবী ছিল অত্যন্ত সামান্য যে আইন মোতাবেক বৃদ্ধাশ্রমগুলি যারা পরিচালনা করেন তাদের জন্য একটি সরকারী নীতি গ্রহণ করা হোক এবং আইন অনুযায়ী প্রত্যেক জেলাতে সরকারী উদ্যোগে একটি বৃদ্ধাশ্রম হোক যেখানে প্রান্তিক প্রবীন মানুষরা আশ্রয় পেতে পারেন। কিন্তু প্রবীন নাগরিকদের এই দাবী আজও অমীমাংসিত। বিশ্ব প্রবীন নাগরিক দিবস ১লা অক্টোবর উদযাপিত হয় কিন্তু দিবসটি উদযাপিত হয় প্রবীনদের অধিকারকে বরফ জলে ডুবিয়ে দিয়ে।
• ২০১৭ সালে বিভিন্ন কারখানার অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকরা তাদের ন্যূনতম PF, Pension বর্ধিত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দেন যে Pension বৃদ্ধি করার দাবী সঠিক হলেও তাদের পক্ষে বাড়ানো সম্ভব নয় কারন সরকারের অর্থ নেই। শ্রমিকদের ন্যূনতম পেনশন ১০০০ টাকাই দেওয়া হবে, তার বেশী সম্ভব নয়। যদিও ২০১৭ সালের পরে জনপ্রতিনিধিদের পেনশন বৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু শ্রমজীবিদের পেনশন বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারী অনিহা। ভারতীয় সংবিধানের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সরকারকে এমন একটি পেনশন দিতে হবে যে পেনশন একজন প্রবীন নাগরিক তার পরিবার নিয়ে যাতে বেঁচে থাকতে পারেন সুস্থভাবে। আজকের দিনে ১০০০ টাকায় কোন প্রবীন দম্পতির বাঁচা সম্ভব নয় তবুও তাঁদের বাঁচতে হবে কারন সরকারের পয়সা নেই অথচ সরকারী নতুন ভবন হবে, মন্দির হবে, আরও অনেক কিছু হবে কেবলমাত্র প্রবীন নাগরিকরা ক্ষুধার্ত হয়ে রাতে শুতে যাবেন। মাননীয় হাইকোর্টের সময়ের অভাব ফলত প্রবীন নাগরিকদের জনস্বার্থ মামলা শোনার সময় নেই তাদের।
• ২০১৬ সাল ও ২০১৮ সাল, যখন পরিবেশ কর্মীরা জলাভূমি ভরাটের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করলেন এবং হাইকোর্ট জলাভূমি সংরক্ষনের আদেশ জারী করলেন। কিন্তু সেই আদেশ প্রশাসন পালন করল না, তার ফলে ২০১৮ সালে হাইকোর্ট অবমাননার মামলা হল কিন্তু আজও তা শুনানির জন্য বিচারকরা সময় পান নি।
এই রকম অনেক হাইকোর্ট অবমাননার মামলা বিচারের জন্য প্রতীক্ষারত কিন্তু সময়ের অভাব তাই বিষয় গুলি বিচার পায় না।
• ২০১৮ সালে হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা হল। মামলাটির সারবস্তু হল যে বিভিন্ন সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কোনরকম নিয়মনীতি না থাকার ফলে ক্রমাগত শিশুরা মারা যাচ্ছে কিন্তু আজ পর্যন্ত রাজ্য সরকার সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি সম্পর্কে কোন নিয়মনীতি স্থির করতে পারলেন না। সরকার যাতে অন্যান্য রাজ্যে সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যে সমস্ত নিয়মনীতি মানা হয় তা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও কার্যকারী করা হোক বলে যে দাবী করা হয়েছিল তা গৃহীত হয়নি ফলত শোকার্ত বাপ মায়ের অনুরোধে জনস্বার্থ মামলা হাইকোর্টে রুজু হয়, ৫ বছর অতিক্রান্ত কিন্তু একটা দিনের জন্যও এই বাংলার শুনানী হয় নি। শিশু মৃত্যুও আমাদের বিচলিত করে না।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সুপ্রীম কোর্ট বা হাইকোর্টে শ্রমজীবি ব্যক্তিরা তাদের দাবী নিয়ে মামলা করেন এবং একথা অনস্বীকার্য সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় বিচারপতি কুলদীপ সিং বা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিরা বহুক্ষেত্রে যুগান্তকারী আদেশ জারী করেছেন মানুষের মানবাধিকার সংরক্ষনের ক্ষেত্রে, পরিবেশ সংরক্ষনের ক্ষেত্রে বা অসহায় মানুষের জীবন জীবিকার স্বার্থে। সাম্প্রতিক কালে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আক্ষেপ করেছেন বিলম্বিত বিচারের ব্যাপার নিয়ে। একথা সর্বজনবিদিত বিচারের বিলম্বতা প্রকৃতপক্ষে ন্যায়ের পরিপন্থি। তবুও ভারতবর্ষের ১৪০ কোটি মানুষ তাকিয়ে আছে ভারতীর বিচার ব্যবস্থার দিকে। নাগরিক সমাজ বহু ব্যাপারে পথে নেমে আন্দোলন করেছেন আজকে বোধহয় সময় এসেছে দ্রুত বিচারের দাবীতে নাগরিক সমাজের আন্দোলনের প্রস্তুতির। বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা যত বৃদ্ধি পাবে ততই আক্রান্ত হবে সংবিধান প্রদত্ত মানুষের অধিকার।
বিশ্বকবি তথা দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। পরিস্থিতির পরিবর্তনে আজ বিলম্বিত বিচারে প্রান্তিক মানুষ নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়
চলভাষ – ৮৪২০৭৬২৫১৭
ই-মেল – biswajit.envlaw@gmail.com
Disclaimer:
- The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
- The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s).
- All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
- No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).