You are currently viewing বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কুশীলবদের কথা ও কাহিনি

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কুশীলবদের কথা ও কাহিনি

Share this post

পশ্চিমবঙ্গের বুকে সাম্প্রতিক কালে পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। তার আগেই অনুষ্ঠিত হয়েছে পৌর নির্বাচন। গ্রামে-গঞ্জে-শহরে জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব নিয়েছেন মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবেশগত স্বাচ্ছন্দ্য আনা সহ নানাবিধ জনমুখী প্রকল্পের বাস্তবায়নে। পৌর তথা পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের পরিবেশগত কাজকর্মের ব্যাপারে উৎসাহ যে খুব আশাব্যাঞ্জক, তা মনে হয় না। তবুও এ কথা অনস্বীকার্য যে, পরিবেশগত আইনগুলি বিশেষ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নদী সংস্কার, জলাভূমি সংরক্ষণ সহ নানাবিধ কাজের দায়িত্ব সাংবিধানিক ভাবে জনপ্রতিনিধিদের উপর বর্তায়। সমস্ত পৌরনিগম, পুরসভা এবং পঞ্চায়েতের দিকে চোখ ফেরালেই দেখা যায় বর্জ্যের পাহাড়। আর এই বর্জ্যের পাহাড়ে কী না নেই! প্লাস্টিক, ছোট ছোট ফেলে দেওয়া ব্যাটারি, বিভিন্ন বাড়ি বা হোটেল থেকে ফেলে দেওয়া বর্জ্য সহ নানাবিধ ফেলে দেওয়া ওষুধ আর ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ।

১৯৮৬ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অন্তর্গত ২০০০ সালে কঠিন বর্জ্য বা কঠিন পৌরবর্জ্য সংক্রান্ত নিয়মাবলী ভারত সরকার প্রকাশিত করেন । এই দীর্ঘ ২৩ বছরের মধ্যে বেশ কয়েকবার পৌর নির্বাচন হয়ে গেল এবং নির্বাচনের সময় সমস্ত রাজনৈতিক দলই ইস্তাহার প্রকাশ করলেন, যে ইস্তাহারে ভাসা ভাসা পরিবেশ বিষয়ক কথা উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু একবারও বলা হল না দীর্ঘ ২৩ বছরের মধ্যে কঠিন পৌরবর্জ্যের ব্যবস্থাপনা কেন হল না। অথচ আমরা প্রত্যেকে আমাদের বাড়ির বর্জ্য পদার্থ বা আমাদের ফেলে দেয়া অপ্রয়োজনীয় অসংখ্য জিনিস ক্রমাগত ডাস্টবিনে ফেলে দিই এবং পৌরসংস্থা মাঝে মাঝে গাড়ি করে এসে আমাদের ফেলে দেয়া বর্জ্য তুলে নিয়ে চলে যায়। সাম্প্রতিককালে বাড়ি থেকে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্যকে পৃথকভাবে তুলে নেবার জন্য গাড়ি করে লোক আসছে। এই উদ্যোগ নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু এদের বাইরেও এমন কিছু পুরুষ, মহিলা ও শিশু আছে যারা আমাদের ফেলে বর্জ্য সংগ্রহ করেন এবং সেই বর্জ্য থেকে সম্পদ তৈরির প্রক্রিয়াকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। এঁরা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ান, পরনে নোংরা জামাকাপড়, পায়ে জুতো নেই, হাতে গ্লাভস্ নেই, মুখে নেই কোন আচ্ছাদন। এঁদেরই চলতি নাম কুড়ানি। এঁরা প্রত্যেকেই প্রান্তিক ঘরের নেই রাজ্যের মানুষ। এঁদের বাসস্থান রাস্তার ধারে বা কোন বস্তিতে বা রেললাইনের ধারে। সকাল থেকেই এঁদের দেখা মেলে আস্তাকুঁড়ে, নালা-নর্দমায়। রাস্তা থেকে এঁরা কাগজ, প্লাস্টিক, শিশি বোতল সহ নানা ভাঙাচোরা জিনিষ সংগ্রহ করে ঝোলায় ভরেন। দিনান্তে পরিতক্ত জিনিসগুলো নিয়ে ওঁরা চলে যান। বিভিন্ন বর্জ্য সংগ্রহকারী ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে তাঁরা পৌঁছে যান এবং সামান্য অর্থের বিনিময়ে সংগৃহীত বর্জ্য বিক্রয় করতে বাধ্য হন। এই কুড়ানিদের একটা বড় অংশ মহিলা বা শিশু যাঁদের পেটে ক্ষুধার আগুন আর সেই আগুন নেভাতে ওঁরা নির্দ্বিধায় নেমে পড়েন নর্দমা বা ডাস্টবিনের ভিতর। ডাস্টবিনের ময়লার মধ্যে দাঁড়িয়েই খুঁটে খুঁটে বের করেন তার মধ্যে থেকে কোনগুলিকে বিক্রয় করলে অর্থ পাওয়া যাবে। এই বর্জ্য থেকে জিনিষপত্র বের করার সময়ে ওঁদের হাত ক্ষতবিক্ষত হয়, কিন্তু থেমে থাকলে ওঁদের চলবে না কারণ পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। সমগ্র ভারতবর্ষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তথা শহর পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে এই কুড়ানিদের অবদান এক অনুচ্চারিত সত্য। রাজ্যে “সবুজ শহর” পরিকল্পনা আরম্ভ হয়েছে যার অন্যতম উদ্দেশ্য শহরকে পরিবেশ-বান্ধব হিসাবে গড়ে তোলা। শহরকে পরিবেশ-বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে গেলে কঠিন বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত আবশ্যিক এবং এই আবশ্যিক কাজটির ক্ষেত্রে কুড়ানিদের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় কুড়ানিদের সম্পর্কিত ভাবনা ব্রাত্য। এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে যে কর্মসূচি প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই হতভাগ্য কুড়ানিদের ব্যাপারে একটি শব্দও ব্যবহৃত হয়নি ।

‘শ্রমিক কল্যাণ সমিতি’, চন্দননগর-এর পক্ষ থেকে কয়েক বছর যাবৎ রাজ্য সরকারকে পৌরনিগমের সাফাইকর্মী ও কুড়ানিদের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি বারবার জানানো হয়েছে। কিন্তু পৌরনিগমের কর্তাব্যক্তিরা মাঝে মাঝে খালি নির্দেশিকা দেন পৌর সাফাইকর্মী বা কুড়ানিদের সুযোগসুবিধাগুলি কার্যকরী করার জন্য। বিভিন্ন পৌরসংস্থা ও পঞ্চায়েতের সঙ্গে আলোচনা করে দেখা গেছে যে, এ ব্যাপারে তাঁরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং সাফাইকর্মী ও কুড়ানিদের দুর্দশা নিয়ে তাঁরা বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। সাম্প্রতিক কালে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে সাফাইকর্মিদের মৃত্যু নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এখনও পর্যন্ত কোন পৌরপ্রতিষ্ঠান সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারের আগে কোনরকম বিষাক্ত গ্যাস সেখানে আছে কিনা, তা পরীক্ষা করার কোন বন্দোবস্ত করেননি। অতীতে কয়লাখনিতে খাঁচায় মুনিয়া পাখি নামানো হত এবং যদি দেখা যেত মুনিয়া পাখি বেঁচে আছে, তবে সেখানে কর্মী নামানো হত। তারপর থেকে অনেক সময় পেরিয়েছে, মানুষ চাঁদে হাঁটছে, মঙ্গল গ্রহে হাত বাড়াচ্ছে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যার যন্ত্র আবিষ্কার হচ্ছে, কিন্তু এই হতভাগ্য সাফাইকর্মিদের জীবন রক্ষার জন্য সামান্য যন্ত্রটি তৈরি হলেও আজও ব্যবহৃত হল না। সাফাইকর্মিরা আজও নীলকন্ঠ হয়েই সমাজে মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিভিন্ন শিল্পসংস্থার দূষণ নিয়ে যখন মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতি শ্রদ্ধেয় শ্রী কুলদীপ সিং মহাশয় নানাবিধ নির্দেশ দিচ্ছেন, তখন সেই মামলার ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষের শারীরিকভাবে কাজ করার পরিবেশও আলোচিত হয়। তদানীন্তন সময়ে ঝাড়গ্রামে অবস্থিত চিচুরগেড়িয়া পাথর-কলের শ্রমিকদের পেশাগত রোগের ব্যাপারে নাগরিক মঞ্চ মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতে একটি মামলায় যুক্ত হয় এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে পাথর-কলে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে ঐতিহাসিক রায় ঘোষিত হয়। সেই সময়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন সর্বোচ্চ আদালতে পেশ করা হয় পৌর এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যুক্ত কর্মিদের কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণ প্রদানের বিষয়টি নিয়ে। মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দে, কিন্তু সেই নির্দেশ রাজ্য সরকার উপেক্ষাই করল, তবে প্রজ্ঞাপিত ‘কঠিন বর্জ্য আইন, ২০০০’-তে বিশেষ করে কুড়ানিদের বিষয়টি উচ্চারিত হল এবং পৌরসংস্থায় কর্মরত শ্রমিকদের কাজ করার সময় কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য উপকরণ প্রদানের বিষয়টি উঠে এল। কিন্তু কার্যত বিশেষ কিছুই হল না। এমনকি বিভিন্ন পৌর প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যাচ্ছে, সরকারি বিজ্ঞাপিত ন্যায্য মজুরি পর্যন্ত সাফাইকর্মিদের দেওয়া হয় না। বিষয়টি শ্রম দপ্তরের নজরে আনলেও শ্রম দপ্তর এ ব্যাপারে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন।

আইনে যাই লেখা থাকুক, বাস্তবে এঁরা আমাদের ভাবনার পরিমন্ডলের মধ্যে আসেন না। নির্বাচন আসে নির্বাচন যায়। দরিদ্র মানুষদের জন্য ভাবনাচিন্তায় অস্থির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদর্পে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন, জনগণ হাততালি দেয়। আর আমাদের হতভাগ্য কুড়ানিরা ঘিঞ্জি বস্তিতে বা রেললাইনের ধারে আলোহীন জলহীন ভাঙাচোরা ঘরে কোনরকমে রাত কাটান, আর সকাল হলেই ভোরের সূর্যকে সাক্ষী রেখে বেরিয়ে পড়েন আমাদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট সংগ্রহে। ওঁরাই আমাদের জীবনযাত্রার ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। আগামীদিনে এই কুড়ানিদের ভাগ্যাকাশে কোন সুস্থতা আসবে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলবে।

একইভাবে বলা যেতে পারে, পৌর সাফাইকর্মিদের জীবনে কবে দুর্দশা কাটবে, তা আজও অজানা। তবে প্রচেষ্টা তো চালাতেই হবে, কারণ আমাদের শহরকে প্রকৃতপক্ষে এরাই পরিষ্কার রাখে কেবল নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে। এদের জন্য কোন বুদ্ধিজীবী নেই, নেই কোন বিশেষ তথাকথিত রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট বিশিষ্টজন, তবুও এরা বাঁচবে নিজেদের জীবনযুদ্ধে অপরাজেয় সৈনিক হিসেবে।

বিনীত,
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়,
উপদেষ্টা, শ্রমিক কল্যাণ সমিতি, চন্দননগর।
ফোন – ৮৪২০৭৬২৫১৭,
ইমেল-biswajit.envlaw@gmail.com

Disclaimer:

  • The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
  • The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s). 
  • All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
  • No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).

Share this post

Leave a Reply