ভারতের সংবিধান কর্তৃক ভারতীয় নাগরিকদের যে সমস্ত মৌলিক অধিকার প্রদান করা হয়েছে তার মধ্যে দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার যথাক্রমে (১) মত প্রকাশের অধিকার, এবং (২) বেঁচে থাকার অধিকার । দুটি অধিকারই পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং ভারতের গণতন্ত্রের অন্যতম আধার । প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, সংবাদ সংস্থার অধিকার গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ এই ব্যাপারে কোন রকম হস্তক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের ওপরই আক্রমণ । সংবাদ সংস্থাতে যুক্ত সাংবাদিকরা সংবাদ পরিবেশন বা সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে যদি কোন রকম বাধা পান সেটাও বস্তুতঃ গণতান্ত্রিক কাঠামোর পক্ষে অশনি সংকেত ।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা এবং মানুষের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে ও রাজনৈতিক কাজকর্ম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সুরক্ষিত করার জন্য সৃষ্ট । পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল ধরেই নির্বাচনের সময় ব্যাপকভাবে নাগরিকরা তথা সাংবাদিকরা আক্রান্ত হচ্ছেন এবং সমস্ত দলেরই রাজনৈতিক কর্মীরা নানাভাবে দৈহিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, এমনকি মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করছেন । ভোটের দিন বহু ভোটার আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন । রাজনৈতিক সন্ত্রাসের মূল্য দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ ।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে ভোট প্রদান করতে গিয়ে বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে গিয়ে যদি কোন নাগরিক আক্রান্ত হন কিংবা মারা যান এবং তার জন্য যদি ক্ষতিপুরণ না পান তবে ভবিষ্যতে মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংকুচিত হয়ে পড়বেন এবং সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন না । বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে সৃষ্টি হবে এক অদ্ভুত আঁধার যা সমাজের পক্ষে অশনি সংকেত বহন করে নিয়ে আসবে ।
এমতাবস্থায় একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত দাবি নির্বাচন কমিশনের কাছে যে —
১) ভোটে অংশগ্রহণকারী কোন প্রার্থী বা প্রার্থীর এজেন্ট বা প্রার্থীর কর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যদি কেউ আক্রান্ত হন বা মৃত্যুবরণ করেন তাঁদের পরিবারকে যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে,
২) ভোট দিতে গিয়ে যদি কোন নাগরিক আক্রান্ত হন বা মৃত্যুবরণ করেন তাঁকে বা তাঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, কারণ নির্বাচন কমিশন সবাইকে ভোট দিতে আহ্বান করেন । সুতরাং নাগরিকরা যাতে সুস্থভাবে ভোট দিতে পারেন তার দায়ভার নির্বাচন কমিশনের,
৩) আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পত্তি নষ্ট হলে সেক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে,
৪) নির্বাচন প্রক্রিয়া ঘোষণার পরে কোন সাংবাদিক যদি আক্রান্ত হন তাঁদেরও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং সাংবাদিকদের সর্বতোভাবে সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে হবে ।
এই সমস্ত ক্ষতিপুরণের দায় নিতে হবে বিধানসভা, পৌরসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে রাজ্য সরকারকে এবং লোকসভা নির্বাচনের সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে । ক্ষতিপূরণ কে বা কারা পাবেন তার মূল্যায়ন করার দায়িত্ব থাকবে নির্বাচন কমিশনের উপর ।
আক্রান্ত বা নিহত ব্যক্তিরা মূলতঃ সমাজের দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম অংশের প্রান্তিক নাগরিক এবং এঁরাই “গণতন্ত্রের শহীদ” । এঁরা প্রত্যেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণের দাবিদার । নির্বাচন কমিশন তার সমস্ত কাজ পরিচালনা করে মানুষের দেয় কর থেকে এবং রাষ্ট্র যদি মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে না পারে তাহলে রাষ্ট্র অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য । নির্বাচন কমিশনকে এই ব্যাপারে দীর্ঘকাল ধরে আইন সহায়তা কেন্দ্রের মাধ্যমে ক্রমাগতঃ দাবি পেশ করা হয়েছে এবং এই ব্যাপারে মাননীয় হাইকোর্টেও জনস্বার্থ মামলা বিচারের অপেক্ষায় ।
কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে লেখা পত্রের জবাবে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন লিখিতভাবে জানাচ্ছেন যে নির্বাচন কমিশন যে সমস্ত আইন কার্যকরী করেন সেই সমস্ত আইনে ভোট সন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে বা নিহত বা আহত ব্যক্তিদের কোন রকম ক্ষতিপূরণ দেবার এক্তিয়ার নেই । কিন্তু নির্বাচন কমিশন ভোট সন্ত্রাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের দাবিকে অস্বীকার করেননি এবং আমাদের জ্ঞাত করেছেন যে যদি কোন ব্যক্তি বা সংগঠন ভোট সন্ত্রাসে অভিযুক্ত থাকেন তবে অন্যান্য প্রচলিত আইনের সহায়তা নিয়ে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে ।
নির্বাচন কমিশনের এই মতামত ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের কাঠামোতে ও পরিমন্ডলে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে এবং বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে —
(১) নির্বাচন কমিশন নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোটে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দায়বদ্ধ । কিন্তু শান্তি বিঘ্নিত হলে নির্বাচন কমিশন তার দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যেতে পারেন না এবং নির্বাচন কমিশনের এই নেতিবাচক ভূমিকা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক ।
(২) নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের কিছুদিন আগে প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নির্বাচনের গণনা শেষ হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনই প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেন । এই সময়ে নির্বাচনী সন্ত্রাসে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হন সেই ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন যদি দায় নিতে অস্বীকার করেন তাহলে পরবর্তী ক্ষেত্রে প্রশাসনও আর কোন.দায়িত্ব নিতে চাইবেন না ।
(৩) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন একটি দল শাসন ক্ষমতাতে আসেন এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে শাসকদল বিরোধীদলের কর্মীদের দায়িত্ব সচেতন ভাবে অস্বীকার করবেন । ফলতঃ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা আক্রান্ত হবে ।
সর্বশেষে বলা প্রয়োজন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব অস্বীকারের ফলে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হবে । অগণতান্ত্রিক শক্তি, উগ্রপন্থী শক্তি, নৈরাশ্য সৃষ্টিকারী শক্তি আরো উৎসাহিত হবে যখন তারা জানতে পারবে তাদের দ্বারা অত্যাচারিত মানুষ নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে কোন রকম সাহায্য পাবেন না । আইন তৈরি হয় সমাজের প্রয়োজনে । বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনকেই উদ্যোগ গ্রহণ করে নির্বাচনী সন্ত্রাসে আক্রান্ত মানুষদের ক্ষতিপূরণের কথা ভাবতে হবে এবং প্রয়োজনে আইন সংশোধনের প্রস্তাব আনতে হবে । কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশন নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিকেও এই ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে । কিন্তু দুঃখের হলেও সত্যি, পশ্চিমবঙ্গে তথা অন্যান্য রাজ্যে নির্বাচনের সময়ে বা আগে অথবা পরে সন্ত্রাসে যাঁরা মারা যান তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেবার ব্যাপারেও বিধানসভা বা লোকসভায় শাসকদল বা বিরোধী দলের কোন রকম উদ্যোগ দেখা যায় না । আমরা এই ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলিকেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অবহিত করেছিলাম, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি এই ব্যাপারে কোন কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই । এই উদ্যোগহীনতা ও ঔদাসীন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক কারণ রাজনৈতিক দলগুলিই সুনির্দিষ্ট চিন্তাভাবনার মাধ্যমে লোকসভা ও বিধানসভায় আইন তৈরি করে থাকেন । আজকের পরিস্থিতিতে নির্বাচনের সময় বা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ও সাংবাদিকদের ক্ষতিপূরণ দেবার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অন্যথায় মানুষের মৌলিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার ও বেঁচে থাকার অধিকার সবই হারিয়ে যাবে এক অন্ধকার জগতে, যার ফলে ভেঙে পড়বে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ।
বিনীত,
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়
সম্পাদক
আইন সহায়তা কেন্দ্র
ফোন – 8420762517
ই-মেল – biswajit.envlaw@gmail.com
Disclaimer:
- The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
- The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s).
- All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
- No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).

