[ ভারতবর্ষ জুড়ে ধর্মস্থান বা মূর্তি নির্মাণের জোয়ার এসেছে । কিন্তু ঐতিহাসিক স্থানগুলি বা আমাদের ঐতিহ্যের পরম্পরা বহন করছে যে সমস্ত স্থাপত্য তা আজ অবহেলার পাত্র । এই প্রেক্ষাপটেই এই প্রতিবেদন ]
বিশ্বভাবনায় ঐতিহ্য
১৯৭২ সাল । সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে পরিবেশের সংরক্ষণ নিয়ে ভাবনা-চিন্তাকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে ৫ জুন স্টকহলমে সম্মেলনের আয়োজন । তারপর থেকে আরম্ভ হল আন্তর্জাতিক স্তরে পরিবেশ নিয়ে সংগঠিত ভাবনার প্রয়াস । পরিবেশ দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে ১৯৭২-এ স্টকহলম সম্মেলন পৃথিবীর মানুষের কাছে অতি পরিচিত একটি অধ্যায় । ১৯৭২ সাল পৃথিবীর বুকে পরিবেশের আন্তর্জাতিক ভাবনার দিগন্ত হিসেবে চিহ্নিত হলেও ওই বৎসরই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন পৃথিবীর ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলিকে সংরক্ষণের জন্য অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলনে ১৭৮ টি দেশ যোগদান করে এবং পৃথিবীর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করার এক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি হল । এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ১৭৮ টি দেশ স্বীকার করে নেয় যে বিভিন্ন কারণে পরিবেশের যেমন ব্যাপক ক্ষতিসাধন হচ্ছে ঠিক তেমন ভাবেই হাজার হাজার বৎসর ধরে গড়ে ওঠা মানুষের সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে ।
ভারতীয় সংবিধানে ঐতিহ্য
শিল্পবিপ্লব, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পরবর্তীকালে নানাভাবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছেন, এমনকি জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি বিস্মৃতির আঁধারে তলিয়ে গেছে । ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক দুটি সম্মেলনে, ভারতবর্ষ সনদের সাক্ষরকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত । প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২ সালের পর পরিবেশ সংরক্ষণে ভারতবর্ষের বুকে একগুচ্ছ আইন প্রণয়ন হয়েছে কিন্তু ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট সংস্থা তৈরি করতে অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে । ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধে ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক স্থান সহ ইতিহাসের নিরিখে বিবেচিত বিষয়গুলির রক্ষণাবেক্ষণের ভাবনা উচ্চারিত হল । ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের দায়িত্বে স্থান পেল ঐতিহ্য রক্ষার কথা । ভারতীয় সংবিধানে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে ক্ষমতার সুনির্দিষ্ট বিভাজিত রূপ বর্তমান । কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত হল বিভিন্ন ঐতিহাসিক, পুরাতত্ত্ব সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং রাজ্যস্তরেও ক্ষমতার বিন্যাসে প্রাচীন গ্রন্থাগার, সংগ্রহশালা সহ ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হল । লিখিতভাবে ভারতীয় সংবিধানে অনেককিছু বলা হলেও বাস্তবে তার রূপ নিতে অনেক সময় পেরিয়ে গেল । ভারতবর্ষের মাটিতে একটির পর একটি সভ্যতা বিকশিত হয়েছে আর তার ফলে ভারতবর্ষের মাটিতে ছড়িয়ে আছে বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্যের সম্ভার যা আজও অনেকটাই অনাদরে অবহেলার শিকার বা অনাবিষ্কৃত অবস্থাতেই বিস্মৃতির জগতে বিরাজ করছে ।
রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা
পশ্চিমবঙ্গের বুকে ২০০১ সালে Heritage Commission Act চালু করা হয় । এই আইনে সুনির্দিষ্টভাবে ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বিষয়গুলিকে চিহ্নিত করে রক্ষার দায়িত্বের কথা বলা হল । এই আইনের সূত্র ধরেই পৌর ও পঞ্চায়েত বিষয়ক আইনের মধ্যেও ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলিকে চিহ্নিতকরণের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে করার জন্য কমিটি তৈরি করার কথা বলা হল । পরিবেশ সুরক্ষা আইন ১৯৮৬ -র মধ্যেও ঐতিহ্যমন্ডিত স্থানগুলিকে পরিবেশগতভাবে রক্ষার কথা লিপিবদ্ধ হল । কিন্তু দুঃখের হলেও এটা সত্যি যে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের নিস্পৃহতা যেমন লক্ষ্য করা গেছে ঠিক একইভাবে ঐতিহ্য সংরক্ষণে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা অনেক ক্ষেত্রে প্রায় নিষ্ঠুরতার নামান্তর হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে । এই কারণেই দেখা যায় সর্বোচ্চ আদালতকে এগিয়ে আসতে হয় তাজমহল থেকে গঙ্গা এমনকি অজন্তা, ইলোরার মতন ঐতিহ্যের পরম্পরা বহনকারী স্থানকে রক্ষা করতে । বিচার বিভাগকে ভাবতে হয় বায়ুদূষণ নিয়ে, তার সঙ্গে তাজমহলের সংরক্ষণ নিয়েও । আইন আছে, তাকে কার্যকরী করার জন্য প্রশাসনও বর্তমান । তবুও প্রশ্ন ওঠে কেন কার্যকর হচ্ছে না ? সম্ভবতঃ উত্তর একটাই, কিছু মানুষের লোভ গ্রাস করেছে সংবিধানের বিধানকে । ফলতঃ পরিবেশ আর ঐতিহ্য সংরক্ষণের একমাত্র আশা ভরসা এখন বিচার বিভাগের সক্রিয়তা । তার অন্যতম উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গের বুকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সৌধকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হয় কোলকাতা হাইকোর্টকে ।
ভারতবর্ষের মাটিতে যে ঐতিহ্যের পরম্পরা সৃষ্টি হয়েছে তাকে রক্ষা করা জরুরি কেবলমাত্র অতীতকে জানার জন্য নয় । ঐতিহ্যের পরম্পরার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে অতীতে মানুষের বুদ্ধি বিভাসিত জীবনচরিত । আমরা জানতে পারি আমাদের ভৌগোলিক, সামাজিক ও অর্থনীতির সূত্রকে । তাজমহল থেকে অজন্তা, ইলোরা, কোনারকের সূর্যমন্দির থেকে দক্ষিণের মাদুরাই মন্দির সর্বত্রই লুকিয়ে আছে অজানা ইতিহাসের কথা, যার আবর্তে আন্দোলিত হয় বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও তদানীন্তন প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের এক অনন্য চিত্র । কেবল স্থাপত্যের মধ্যে নয়, ঐতিহ্যের পরম্পরা খুঁজতে হবে ভারতবর্ষের বহু বিস্তৃত প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে । আঞ্চলিক জলবায়ু ভিত্তিক কৃষিকার্যের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ভারতবর্ষের মাটিতে সৃষ্ট এক অনন্য কৃষিভিত্তিক সভ্যতা । হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো সভ্যতা আমাদের শিক্ষা দেয় আজকের দিনে বেড়ে চলা নগরায়নের গতিপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে কিভাবে প্রয়োজন পড়ে পরিবেশ বান্ধব নীতির আলো-কে ।
ঐতিহ্যের অর্থনীতি
ঐতিহ্য রক্ষার সঙ্গে জড়িত এক বিশাল অর্থনীতির সূত্র । তাজমহলের সৌন্দর্যকে আক্রান্ত করে যাঁরা নগরায়নের প্রস্তুতি নেন তাঁরা সাময়িক লাভের কথা ভাবছেন কিন্তু এই তাজমহলকে কেন্দ্র করে যে বিশাল ভ্রমণ শিল্প গড়ে উঠেছে সেকথা অনেকটাই আমরা ভুলে যাই । একথা বললে অত্যুক্তি হবে না ভারতবর্ষের মাটিতে ঐতিহ্যের পরম্পরা যেভাবে বিদ্যমান ও তার সঙ্গে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের যে সম্ভার আজও বর্তমান তাকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ শিল্পে যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে তা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারি না ।
পশ্চিমবঙ্গের বুকে বিভিন্ন জেলার পীঠস্থানগুলিকে সামনে রেখে যে বিপুল পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটা সম্ভব ছিল, তা প্রায় অধরাই থেকে গেছে ।
তবু জেগে থাকে আশা
ভারতবর্ষ জুড়ে পরিবেশের ব্যাপার নিয়ে কমবেশি আন্দোলন হলেও ঐতিহ্য সংরক্ষণ নিয়ে নাগরিক আন্দোলন প্রায় গড়েই ওঠেনি । এমনকি প্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে রক্ষা করার জন্য যেটুকু আইন আছে তা প্রায় সর্বত্রই লঙ্ঘিত হচ্ছে । শান্তিনিকেতনের বিবেচনাহীন নগরায়ন থেকে মন্দারমনি সমুদ্রতট সবই আক্রান্ত । আক্রান্ত হচ্ছে ডুয়ার্সের জঙ্গল, শৈলশহর, পূর্ব কোলকাতার জলাভূমি থেকে সুন্দরবনের ব্যাঘ্রপ্রকল্প । ঐতিহ্যের মধ্যে জড়িয়ে আছে আমাদের অতীতের কথা, বর্তমানের পথচলা আর ভবিষ্যতের দিশা । এত হতাশার মধ্যেও তবু জেগে থাকে আশা । দেরিতে হলেও নাগরিক সমাজের ক্ষুদ্র একটি অংশ ভাবতে আরম্ভ করেছেন ঐতিহ্যের পরম্পরা নিয়ে । হয়তো এই ভাবনাই আগামী দিনে জাগ্রত করতে পারবে রাষ্ট্রনেতাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং নাগরিক সমাজের কর্তব্যবোধকে । আমাদের চলার পথে ঐতিহ্যের সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও স্মরণীয় সেই রবীন্দ্রনাথ ! বিশ্বকবির ভাবনায় :
হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে
কাজ করে যাও গোপনে গোপনে,
মুখর দিনের চপলতা-মাঝে স্থির হয়ে তুমি রও
হে অতীত, তুমি গোপনে হৃদয়ে কথা কও, কথা কও ॥
লিখেছেন – বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় ( সমাজ ও পরিবেশকর্মী )
Disclaimer:
- The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
- The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s).
- All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
- No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).