প্রেক্ষাপট — বিশ্বকর্মা পুজো থেকে আরম্ভ করে সরস্বতী পুজো পর্যন্ত শব্দদৈত্যের আতঙ্কে মানুষ থেকে জীবজগৎ পর্যন্ত শঙ্কিত থাকতেন এবং ১৯৯২ সালে এই শব্দদানবের বিরুদ্ধে পথে নামলেন পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সভাপতি বিশিষ্ট পরিবেশবিদ অধ্যাপক দেবকুমার বসু ও তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রথিতযশা ই.এন.টি. বিশেষজ্ঞ ডাঃ আবীরলাল মুখার্জী । কোলকাতার বিভিন্ন পুজো মন্ডপে গিয়ে মাইকের শব্দ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আবেদন জানালেন । প্রায় সবাই উপেক্ষা করলেন, তবে কয়েকটি বারোয়ারি-র কর্মকর্তারা, যাঁরা আবেদনকারী ব্যক্তিদ্বয়কে চিনতেন, তাঁরা একটু ইতস্ততঃ করলেন, বললেন – দেখি কি করা যায় । এইভাবে কয়েকটা বছর কাটলো । ১৯৯৪ সালে পর্ষদের পক্ষ থেকে পুলিশকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হয় পুলিশি আইন অনুযায়ী মাইক বাজানোর সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসে পুলিশের মত কন্ট্রোল রুম খুলে গভীর রাতে মাইক বাজানোর অভিযোগ গ্রহণ করা হল । হাসপাতালের সন্নিকটে মাইক বাজানোর অভিযোগ পেলে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুলিশকে উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেওয়া আরম্ভ হল । ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে কোলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি ভগবতী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় শব্দদানবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য আদেশ জারি করলেন । সেই আদেশে ধ্বনিত হল যে মানুষের মৌলিক অধিকারে যেমন কথা বলা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে তেমনই অপরের কথা না শোনারও অধিকার রয়েছে । প্রকৃতপক্ষে এক নতুন ব্যাখ্যা মানুষের কাছে এল যার মূল অর্থ দাঁড়ালো কোন ব্যক্তিকে “বন্দী শ্রোতা”-তে পরিণত করা যাবে না । মাননীয় বিচারপতি ভগবতী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই আদেশনামা ভারতবর্ষের পরিবেশ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করলো, যার অর্থ মানুষের “নৈঃশব্দের অধিকার” । এরপর যা হল তা এক যুগান্তকারী ইতিহাস ।
সদর্থক প্রশাসন — মাননীয় বিচারপতি ভগবতী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে সর্বতোভাবে অধিকার দিলেন যে শব্দদূষণ যে সমস্ত ক্ষেত্র থেকে ঘটে থাকে সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । এমনকি শব্দবাজির ক্ষেত্রেও ।
১৯৯৬ সালে পুজোর সময় রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কোলকাতা পুলিশ ও রাজ্য পুলিশকে নির্দেশ দিলো সমস্ত রকম শব্দ বাজি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, বিশেষ করে সেই সমস্ত বাজি যেগুলি বিস্ফোরণের পর ৬৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দ সৃষ্টি করে । পর্ষদের এই আদেশনামায ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়ালো, কিন্তু কোলকাতা পুলিশ সক্রিয়ভাবে শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে আরম্ভ করলেন । ক্ষুব্ধ বাজি ব্যবসায়ীরা কোলকাতা হাইকোর্টের অবসরকালীন বিচারপতি মাননীয় সমরেশ ব্যানার্জীর কাছে পর্ষদের বিরুদ্ধে মামলা করলো । বাজি ব্যবসায়ীদের হয়ে কোলকাতা হাইকোর্টে প্রথিতযশা আইনজ্ঞরা বললেন যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের জারি করা শব্দবাজির শব্দ নিয়ন্ত্রণের আদেশনামা চূড়ান্তভাবে অসাংবিধানিক ও আইন বিরুদ্ধ । কোলকাতা হাইকোর্টের সওয়াল জবাবে পর্ষদের অ্যাডভোকেট ছাড়াও পর্ষদের আইন আধিকারিক, বাস্তুকার ও বিজ্ঞানীরা একযোগে অংশ গ্রহণ করলেন । হাইকোর্ট আদেশনামা জারি করলেন এবং জানিয়ে দিলেন যে পর্ষদের আদেশনামা সঠিক এবং এই আদেশনামা অনেক আগেই পর্ষদের পক্ষ থেকে দেওয়া উচিত ছিলো ।
বিস্তৃত আইনি লড়াই — হাইকোর্টে ধাক্কা খেয়ে বাজি ব্যবসায়ীরা আইনি লড়াই আরম্ভ করলেন এবং একইসঙ্গে শুরু হল রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে পর্ষদকে নিরস্ত করার চেষ্টা যাতে তাঁরা পুনরায় শব্দবাজি তৈরি ও বিক্রয় করতে পারেন । মাননীয় বিচারপতি ভগবতী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ৭ই মে ১৯৯৭ এবং ২৩শে মে ১৯৯৭ তারিখে সুনির্দিষ্ট আদেশ দিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে আদেশ দিলেন যে বাজির শব্দসীমা পুনরায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিচার বিশ্লেষণ করে স্থিরীকৃত করতে এবং বাজি ব্যবসায়ীদের বক্তব্যও শুনতে হবে । সেই মোতাবেক ৩০শে নভেম্বর ১৯৯৭ সালে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অফিসে বাজি ব্যবসায়ীদের বক্তব্য শোনা হল এবং তৎসহ কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ দ্বারা গঠিত শব্দ নিয়ন্ত্রক কমিটির বিভিন্ন সুপারিশগুলি পর্যালোচনা করা হল । পর্ষদ গঠিত কমিটি পুনরায় সুনির্দিষ্টভাবে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বাজি বিস্ফোরণের স্থল থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল স্থিরীকৃত করলেন এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ তাঁদের মতামত হাইকোর্টে পেশ করলেন । হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তাতে সম্মতি দিলেন । হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বাজি ব্যবসায়ীরা সুপ্রীমকোর্টে গেলেন ও মাননীয় সুপ্রীমকোর্ট ১২ই জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে কোলকাতা হাইকোর্টের রায়কে সম্পূর্ণভাবে অনুমোদন দিলেন । পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্মকান্ডে উৎসাহিত হয়ে কেন্দ্রীয় পরিবেশ দপ্তর শব্দবাজির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ করতে ২০শে অক্টোবর ১৯৯৮ সালে বিজ্ঞপ্তি জারি করলেন এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে কেন্দ্রীয় পরিবেশ দপ্তরকে ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৯ তারিখে পর্ষদের বাজি সংক্রান্ত শব্দসীমা যা নির্ধারিত হয়েছে তা জানিয়ে দেওয়া হল । কেন্দ্রীয় পরিবেশ দপ্তর ২৬শে সেপ্টেম্বর ২০০০ সালে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে পরিবেশ সুরক্ষা আইন অনুযায়ী দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বাজির যে কঠিন শব্দসীমা নির্ধারণ করেছেন তা আইন মোতাবেক । একইসাথে কেন্দ্রীয় বিস্ফোরক দপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হল বাজির শব্দসীমার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করার । এখানেই শেষ নয় । ২৭শে নভেম্বর ২০০১ সালে মাননীয় সুপ্রীমকোর্ট সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করলেন যে কোন রাজ্য যদি মনে করে তাহলে শব্দবাজির ক্ষেত্রে কঠিনতর মাত্রা স্থির করতে পারেন ।
২০০১ সালে সুপ্রীমকোর্ট অর্ডার দেওয়া সত্বেও বাজি ব্যবসায়ীরা কমপক্ষে ৫ বার কোলকাতা হাইকোর্টে বাজির শব্দসীমা শিথিল করার জন্য আবেদন করেছেন কিন্তু প্রত্যেকবারই অনেক বড়ো মাপের আইনজীবী দাঁড় করিয়েও বাজির শব্দসীমা শিথিল করার জন্য কোন আদেশ পান নি এবং পর্ষদের যুক্তির কাছে সর্বদাই তাঁরা পরাজিত হয়েছেন । এরই মধ্যে কয়েকবার বাজি ব্যবসায়ীরা সুপ্রীমকোর্টে গেছেন কিন্তু মাননীয় সুপ্রীমকোর্ট পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আদেশনামা বাতিল করেন নি ।
২১শে আগস্ট ২০১৩ তারিখে গ্রীন ট্রাইব্যুনাল পুনরায় বাজির শব্দের মাত্রা নির্ধারণের জন্য পর্ষদকে আদেশ দেন এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ পুনরায় কমিটি গঠন করে মতামত দেন যে বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল-কে শিথিল করা যাবে না । ১৯৯৭ সালে পর্ষদ বাজির যে শব্দসীমা নির্ধারণ করেছিলেন তা ২০২৩ এর ৮ই অক্টোবর পর্যন্ত বলবৎ ছিলো । কিন্তু হঠাৎ করে ১৭ই অক্টোবর ২০২৩ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ শব্দবাজির ক্ষেত্রে নির্ধারিত সীমা ৯০ ডেসিবেল-কে শিথিল করে দিলেন এবং সেই আদেশনামা মাননীয় সুপ্রীমকোর্টের আদেশকে বিশ্লেষণ করে । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ২০১৮ তে সুপ্রীমকোর্ট বাজি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যে আদেশনামা জারি করেছেন তার মধ্যে বারবারই শব্দবাজি জনিত দূষণ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন । ফলতঃ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ১৭-১০-২৩ তারিখের আদেশনামা সামগ্রিকভাবে আইনের চোখে পরিশীলিত নয় এবং এই আদেশনামা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপের সামিল । মনে রাখা প্রয়োজন দীপাবলী বা কালীপুজো আলোর উৎসব, শব্দের উৎসব নয় । একজনের আনন্দ অপরের দুঃখের কারণ হতে পারে না । কিন্তু বর্তমানে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও রাজ্য সরকারের বর্তমান অবস্থান যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ । আমাদের স্মরণ করতে হয় যে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৪ জন সহ নাগরিক শব্দ শহীদ হয়েছেন এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বর্তমান অবস্থান কার্যতঃ এই শহীদদের লড়াইকে ব্যর্থ করে দিলো । বাজির শব্দসীমা নিয়ন্ত্রণ করার পর পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পক্ষ থেকে মানুষের মধ্যে একটি.সমীক্ষা চালানো হয় । এই সমীক্ষায় দেখা যায় ৯৬% মানুষ শব্দবাজির বিপক্ষে ।
সর্বশেষে বলা প্রয়োজন আইন মানুষের জন্য এবং সেই আইন মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা সরকারের দায়িত্ব । সরকার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে মানুষই প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে এই অনৈতিক কাজের জবাব দেবেন । বিচারের বাণীকে কোনভাবেই নিভৃতে কাঁদতে দেওয়া যাবে না । দিকে দিকে মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন । পরিবেশ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটাই একটা অত্যন্ত সুলক্ষ্মণ ।
বিনীত,
বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়
পরিবেশ ও সমাজকর্মী
ফোন – 8420762517
ই-মেল – biswajit.envlaw@gmail.com
Disclaimer:
- The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
- The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s).
- All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
- No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).