You are currently viewing দূরবীন

দূরবীন

Share this post

কলমে – সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

আমাদের ছোটবেলা চলে বাঁকে বাঁকে.. আসলে আমরা সবাই আমাদের ছোটবেলাটাকে বড্ড মিস্ করি তাই হয়তঃ হারায়ে খুঁজি বারে বারে। এই লেখা আমাদের সব্বার, ফেলে আসা জীবনের কোলাজ ।  আমাদের ছোটবেলার ফুটবল খেলা এখনকার প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না। স্মৃতি বয়ে বেড়িয়ে লাভই বা কি ? তবু বন্ধ মুঠোটা মাঝে মাঝে খুলে ছেলেবেলাটা আবার দেখতে ইচ্ছা করে। 

শেষ ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ হয়ে গেল ডিসেম্বর ২০২২ কাতারে।  আর আমরা টুনু মিঞার মাঠে  ওয়ার্ল্ড কাপ  খেলে ফেলেছি সেই কোন কালে আর আমরা যে ফুটবল খেলেছি তা  পেলেও  খেলেনি কোনোদিন, এই লেখার সাথে মিলিয়ে নিন। মেসি, এমবাপে, রোনাল্ডোরা ওটা ফুটবল খেলে না কি ? ফুটবল খেলতাম তো আমরা। সন্টি, টুটু, হাফিজুর, বাসু, অরুণ, শম্ভু… একেকজন পেলে-জর্জিনহো- গর্ডন ব্যাঙ্কস্ – লেভ ইয়াসীন- টোষ্টাও- ববি ম্যূর- ইউসোবিও-গার্ড ম্যূলার-গ্যারিঞ্চা । 

বাপরে বাপ খেলা কাকে বলে! খেলার আগে গেমপ্ল্যান অনুসারে সবার পজিশন ঠিক হল।  

তোরা তিনজন ডিফেন্সে, আমরা দু’জন মিডফিল্ডে, তুই ডানে, তুই বামে। বল যাঁর সেই স্ট্রাইকার।  অফসাইড বলে কিছু নেই।   

ক্যাপ্টেনের নির্দেশ, “তুই মেইন স্ট্রাইকার, ওঁদের গোলপোষ্টে  হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গোলকিপারের সাথে গল্প কর। নিচে নামার দরকার নেই।   

শুধু আমরা বল এগিয়ে দিলে বলটা গোলে ঠেলে দিবি, ব্যাস ।  খবরদার, মিস করিস না।”  লেস্ বাঁধা বল, তিমলেদার সাইকেল সাড়াইয়ের দোকানে দশ পয়সা দিয়ে নিজেদেরই পাম্প করে নিতে হত। তারপর যন্ত্রপাতি বেড় করে লেস বাঁধাবাঁধি। বলের মালিককে একটু এক্সট্রা তোয়াজ করতেই হত। সাইকেল-পাম্পারের মাথায় চড়ে  হাওয়া ভরে ‘ববি ম্যূর’ টুটু বল টিপে হাওয়া টেষ্ট করত।

খেলা শুরুর মিনিট দশেকের মধ্যে পজিশন-টজিশন সব ভেঙ্গেচুরে একাকার । ডিফেন্ডার চলে গেছে গোল করতে, স্ট্রাইকার এসে ডিফেন্স সামলাচ্ছে।  কিছু বলার উপায় নেই, বলটা ওর, সেন্টিমেন্টে লাগলে বল বগলে হাওয়াই চটি গলিয়ে হাঁটা দেবে। আরো পরে দেখা গেল মাঠের এক কোণায় একটা জটলা আর ঐ জটলার মাঝখানেই বলটা। বল যেখানে, গোলকিপার বাদে, দুই টিমের বাকি সব খেলোয়াড় সেখানে।  

যে যেদিকে  পারছে সেদিক থেকে লাথি মারছে কিন্তু বল বেচারা বের হওয়ার জায়গা পাচ্ছে না।  বাঁশি মুখে যে কথা বলা যায় না, এই বোধটা নোটন রেফারির জীবনে হয় নি, ডাইরেক্ট লালকার্ড দেখিয়ে মাঠে শৃঙ্খলা ফেরাতে গিয়ে ফল হত উল্টো, ওয়ার্ল্ডকাপ প্লেয়ারদের অত লাল-হলুদ কার্ড দেখার সময় কোথায় ? আর দেখালেই বা কে বেরোচ্ছে ? মাঠে কাদা থাকলে সে আরেক দৃশ্য ! জটলার ভিতর লাথালাথি চলছে। এক এক জন বলে অলরেডি তিনবার করে লাথি কষিয়েছে, অথচ বল দু’ইঞ্চিও নড়েনি। আরেকজন পেলে’র স্টাইলে দৌড়ে আসতে গিয়ে পা হড়কে জটলার মাঝে। কাদা ছিটকে আকাশে..  

হঠাৎ একজন একহাতে চোখ ধরে চেঁচিয়ে উঠল, “ঐ দাঁড়া রে, আমার চোখে কাদা পড়ছে।” তারপর আরেক চোখ  খোলা রেখে পাশের টুনু মিঞার হাঁসপুকুরে ঝুপ্ করে দিল লাফ্।  কাদা-জলের ভারে আরেকজনের প্যান্ট কোমর ছেড়ে অভিকর্ষের টানে ভূ- কেন্দ্রের দিকে ছুটছে। নো পরোয়া।  

খেলার শুরুর মিনিট পনের পর থেকেই গোলকিপারের চিল্লানি শুরু হয়েছে, অলরেডি তাঁদের ১৫ মিনিট করে গোলকিপিং করা হয়ে গেছে,  এখন আরেকজনকে গোলকিপার হতে হবে, ওরা এখন স্ট্রাইকিং-এ খেলবে। এরপর আগের স্ট্রাইকার কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠানো হল গোলকিপিং-এ ৷   

এভাবেই সব প্লেয়ার গোলকিপিং, ডিফেন্স, মিডফিল্ড, স্ট্রাইকিং সব

পজিশনে খেলে ফেলে পুরোই অলরাউন্ডার, যেমন ব্যাঙ্কের ষ্টাফ। কখনও কাউন্টারে ক্যাশ নিচ্ছে তো কখনও পাসবই প্রিন্ট করছে। একটা জিনিস বুঝি না,  এই মেসি,নেইমার , এমবাপে, রোনাল্ডো তারা সবসময় একটাই পজিশনে খেলে।

ভালো খেলোয়াড় হতে হলে আমাদের মতো সবখানেই খেলার যোগ্যতা থাকা চাই।  

বোরোলিনের দৌলতে কলকাতায় নেহরু কাপে কয়েকজন বিশ্বকাপার কে দেখার সুযোগ হয়েছিল কারও কারও। বাকিদের  :রেডিওতে “ইডেন উদ্যান থেকে পুষ্পেন সরকার বলছি”…উনিই ভরসা। এত ক্লাবের নামও জানতাম না, মাথাব্যথাও ছিল না। এখন তো বিছানায় শুয়ে সাঁতার, ফুটবল, ক্রিকেট, ক্যারাটে, লন-টেনিস সব অনলাইনে খেলার ব্যবস্থা হাজির কিন্তু অফলাইন খেলার যে কি অপার আনন্দ ছিল আমাদের, লিখে বোঝানো অসম্ভব।

‘খেলার আসর’ তখন বাজার কাঁপানো খেলার পত্রিকা। স্পোর্টস স্টার, দ্য সান,স্পোর্টস্ ওয়ার্ল্ড, দ্য ক্রিকেট.. ওসব আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পথ চলতি মানুষের কানে সাঁটানো থাকত পকেট-ট্রানজিষ্টর, যেতে যেতে দিতেন বিরক্তিহীন নানান প্রশ্নের উত্তর।  

২৪ সেপ্টেম্বর’৭৭ । পেলে এল কলকাতায় সঙ্গে পুরো ইউইয়র্ক কসমস । বড়দের একটাই আফসোস চোটের জন্য আসতে পারেননি আর এক দুনিয়া কাঁপানো ফুটবলার “বেকেনবাউয়ার” । এদিকে আমাদের রেডিওতে যেই শুরু হল, “নমস্কার, ইডেন গার্ডেন থেকে অজয় বসু বলছি…”, বাড়ির বড়দের উত্তেজনা উঠল চরমে। সব্বাই চায়ের কাপ হাতে শুনছে, “…নীল আকাশে পূজোর আগে বাংলার মাঠজুড়ে সাদা কাশফুল আর  ইডেনউদ্যানের সবুজ ঘাসজুরে কসমসের সাদা জার্সি। ১০ নং সাদাজার্সি পরে ময়দানে ফুটবলের বাদশা-পেলে। মাঠে মিঠে রোদের ঝিলিক.., সবুজ-মেরুনও টক্কর দিতে তৈরী। নানা রঙের পোশাকে মাঠের গ্যালারি ভরিয়ে তুলেছে ফুটবলপ্রেমী বাংলার মানুষ, উৎসাহী দর্শক…..” বাংলা ধারাবিবরণীকে বাচিকশিল্পের এক্সট্রিমপর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, দেবদুলাল, অজয় বসু, পুষ্পেন সরকাররা। মানুষ যেন কানদিয়ে খেলা দেখতে পেত “…সুব্রতর লম্বা শট্ , শ্যাম থাপার পায়ে বল, পাস করলেন লক্ষ্য হাবিব..না হল না, মাঝপথে বল কেড়ে নিয়েছেন কার্লোস, যেন উড়ন্ত ঈগল..কার্লোস-পেলে-আবার কার্লোস..বারপোষ্টের কাছাকাছি দুই গোলশিকারি পেলে-কার্লোস..যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে অঘটন.. বিপদের কালোছায়া মোহনবাগানিদের চোখে-মুখে…” বলে চলেছেন অজয় বসু আর আমি হাঁ করে দেখছি শুধু ধারাভাষ্যে বাড়ির বড়দের  মুখ-চোখের অভিব্যক্তি কি ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে ! “…. গোল পোষ্টের কোনাকুনি পৌঁছে গেছেন কার্লোস চিতার মত.. নিপুণ নিশানায়  জোড়াল শট্ ….” ব্যাস !  অদ্ভুত একটা কুঁইইইইই আওয়াজ তুলে কাঁদতে বসলো বাবার বিয়েতে যৌতুক পাওয়া ভালভসেট রেডিও। থাবড়ে-থুবড়ে যখন রেডিও রি-ষ্টার্ট হল ততক্ষনে কসমস প্রথম গোল দিয়ে দিয়েছে। সে একদিন ছিল বটে আমাদের। আজও পথ চলতে কোথাও অনাড়ম্বরপূর্ন ফুটবল প্রতিযোগিতা দেখলে ঝুপ করে নেমে পড়ি গাড়ি থেকে।  অজান্তেই গলা মেলাই দর্শকের সাথে গো ও ও ল। 

ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসা জীবনে এক সময়ে আর তত্ত্ব-নীতিকথা ভালো লাগে না। ফেলে আসা ছোট্টতুচ্ছ, সত্যি অভিজ্ঞতাগুলো কেমন বিশাল গুরুত্ব নিয়ে ফিরে ফিরে আসে, মন ছুটে গিয়ে দাঁড়াতে চায় কোনও এক  নির্জন পথের বাঁকে কিংবা উঁচু টিলায় যেখানে সূর্যের অস্তমিত আলোয়  দূরবীনে চোখ রাখলে দেখতে পাবো এক টগবগে কিশোর ফুটবল ড্রিবল করতে করতে এগিয়ে আসছে আমারই দিকে হয়তঃ সে আমারই ফেলে আসা অতীত।

Disclaimer:

  • The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
  • The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s). 
  • All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
  • No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).

Share this post

Leave a Reply