You are currently viewing পরিবেশ অপরাধ, দেশে-বিদেশে

পরিবেশ অপরাধ, দেশে-বিদেশে

Share this post

মানব সভ্যতার সঙ্গে অপরাধ নামক বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সৃষ্টির আদি থেকে আধিপত্যবাদ, লোভ-লালসাকে ভর করে অপরাধ জগতের সৃষ্টি, তা আজও অব্যাহত। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রতিমুহূর্তে ঘটছে। আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। কিন্তু মানুষের অপরাধের ফলে প্রকৃতি-পরিবেশ যখন আক্রান্ত হয়, তখন সে ব্যাপারটিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিতকরণ আজও সেভাবে আমাদের মননে আঘাত করে না ।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে কায়রো’তে সম্মেলন হয়ে গেল। এই সম্মেলনে উন্নত দেশ, উন্নতিশীল দেশ ও গরিব দেশ সবাই সামিল হয়েছিল। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই সম্মেলনের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হল তার মূল বিষয় হল কে কত ক্ষতিপূরণ পাবে জলবায়ু পরিবর্তনের অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবী জুড়ে এক নতুন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিন্যাস তৈরি করছে যাকে বলা যেতে পারে আন্তর্জাতিক পরিবেশ বাজার। এই বাজারে কেনাবেচা হবে পরিবেশকে সুস্থ রাখার জন্য যাবতীয় উপাদান। কিন্তু এই বাজারে কখনোই আলোচিত হল না পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ ধ্বংসের কারণগুলি এবং বিশ্ব পরিবেশ দিবসের বার্তা অনুযায়ী বা আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী যেসব আইন দেশে দেশে তৈরি হল, তার সুনির্দিষ্ট প্রয়োগের বিষয়টি। যেমন, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি আন্তর্জাতিক জলাভূমি হিসেবে স্বীকৃত। কমবেশি বিদেশি অনুদানও এসেছে বা আসবে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে জলাভূমি রক্ষার জন্য ভারতীয় আইনগুলি কার্যকরী হল কিনা সে ব্যাপারে কারোর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সুন্দরবনের বাঘ বাঁচাতে আন্তর্জাতিক স্তরে অর্থ দেওয়া হয়, কিন্তু সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে রক্ষার জন্য কোন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় কিনা সেটা কখনোই পর্যালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে না।

দুর্ভাগ্যের হলেও একথা সত্য, পৃথিবী জুড়ে প্রত্যেক দেশেই নানা পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক আইন তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু সে আইনের নানান দেশে কার্যকারিতা নিয়ে কোন আলোচনাই শোনা যায় না। অন্যান্য আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের যে চোখে সমাজ দেখে, পরিবেশ আইন ভঙ্গকারীদের সে চোখে সমাজ এখনও দেখতে শেখেনি। কারণ আমরা কম বেশি প্রত্যেকেই প্রতিনিয়ত নানাবিধ পরিবেশ আইন ভেঙে চলেছি। প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ এর ব্যবহার থেকে শুরু করে গাছ কাটা, জলাভূমি ভরাট, রাস্তায় আবর্জনা ফেলা সহ নানাবিধ পরিবেশ অপরাধ আমরা জ্ঞানে বা অজ্ঞানে করে চলেছি। কোন শিল্পপতি যদি নদীতে দূষিত জল ফেলে বা আকাশ কালো ধোঁয়ায় ভরিয়ে দেয়, তাদের আমরা কখনোই পরিবেশ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করি না, বা তাদের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদী ভাষাও শোনা যায় না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে আমার ভোট আমারই দেবার ব্যাপারে আমরা যতটা সোচ্চার ও সচেতন, তার কণামাত্র প্রতিবাদ আমরা দেখি না যখন পৌরসংস্থাগুলি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকেন বা পরিবেশ আইন কার্যকরী করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ভূমিকা পালন করেন।

পরিবেশ অপরাধ সম্পর্কে মানুষ যদি সচেতন না হয়, বা পরিবেশ অপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষ যদি প্রতিবাদী না হয়ে ওঠে, তবে ক্রমাগত জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব নিয়ে সম্মেলন চলবে, আর দূষণকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থ বিনিময়ের পরিকল্পনা চলবে ধনী আর গরিব দেশের মধ্যে। কিন্তু কখনোই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যার স্থায়ী নিরসন ঘটবে না। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সমস্যার স্থায়ী নিরসন ঘটতে পারে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আইনের কার্যকারিতা, পরিবেশ অপরাধের যোগ্য শাস্তি ও তৎসহ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা ও প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক স্তরেও ক্রমবর্ধমান পরিবেশ আইন ভঙ্গকারীর কার্যকলাপের ব্যাপারেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ অতি জরুরি, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নদীগুলির নির্মলতা রক্ষা, সমুদ্রে যথেচ্ছ বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা ও সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী মারণাস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রয়োগ বন্ধ হওয়া আশু প্রয়োজন; কারণ যুদ্ধ ও যুদ্ধের প্রস্তুতি ভুবনজোড়া দূষণ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।

পরিবেশ অপরাধ ও ভারতবর্ষ

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস্‌ ব্যুরো-তে (NCRB) ২০২১-২২ সালে ৬৪,৪৭১টি পরিবেশ অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে। বিগত চার বছরের হিসেবে সংখ্যাটি যথেষ্ট বেশি। NCRB এর প্রতিবেদন Crime in India 2021 থেকে জানা যাচ্ছে যে, মোট নথিভুক্ত অপরাধের বেশির ভাগটাই (৫৪,০২৪) সিগারেট এবং অন্য তামাকজাত দ্রব্য বিধি-র অধীনে হয়েছে। শব্দ দূষণ বিধি-র অধীনে নথিভুক্ত হয়েছে ৭২১৭টি অপরাধ। আর অরণ্য বিধি এবং অরণ্য সংরক্ষণ বিধি-র অধীনে নথিভুক্ত হয়েছে ২২৯২টি পরিবেশ অপরাধ।

রাজ্যওয়াড়ি পরিবেশ অপরাধ

পরিবেশ অপরাধ নথিভুক্তির দিক থেকে তামিলনাড়ু সবচেয়ে এগিয়ে (৪৬,৪৫৮)। এই নথিভুক্তির ৪৬,৪৩৩টি সিগারেট এবং অন্য তামাকজাত দ্রব্য বিধি-র অধীনে হয়েছে। বাকি ২৩টি হয়েছে শব্দ দূষণ বিধি-র অধীনে।

তামিলনাড়ুর পরেই রয়েছে রাজস্থান। এ রাজ্যে নথিভুক্ত মোট পরিবেশ অপরাধের সংখ্যা ৯৩৮৭টি। এর মধ্যে ৭১৬৩টি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে সিগারেট এবং অন্য তামাকজাত দ্রব্য বিধি-র অধীনে, ১৮৭৩টি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে শব্দ দূষণ বিধি-র অধীনে, ২২৪টি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে অরণ্য বিধি-র অধীনে এবং ১০৬টি নথিভুক্ত হয়েছে বন্যপ্রাণ সুরক্ষা বিধি-র অধীনে। এরই সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ১৯টি পরিবেশ অপরাধের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল।

উত্তরপ্রদেশ-এ অরণ্য বিধি এবং অরণ্য সংরক্ষণ বিধি-র অধীনে সবচেয়ে বেশি অপরাধ (১৩১৮) নথিভুক্ত হয়েছে। এর পরেই ঝাড়খণ্ড এর স্থান (২৬৫)। NCRB এর দেওয়া ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী তামিলনাড়ু, রাজস্থান এবং উত্তরপ্রদেশ-এ দেশের প্রায় ৯০% পরিবেশ অপরাধ ঘটে।

NCRB এর প্রতিবেদন Crime in India 2021 অনুযায়ী অরণ্য বিধি-র অধীনে সবচেয়ে বেশি অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে ছত্তিশগড়, উত্তরাখণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল প্রদেশ, চণ্ডিগড়, গুজরাট, ঝাড়খণ্ড, পঞ্জাব, জম্মু ও কাশ্মীর, বিহার, অসম ও উত্তরপ্রদেশ এই ১২টি রাজ্যে। এরই মধ্যে ভারতের অন্য ১০টি রাজ্যে অরণ্য বিধি ভাঙার নথিভুক্তির ঘটনা কমেছে। এই রাজ্যগুলি হল মহারাষ্ট্র, হিমাচল প্রদেশ, কর্ণাটক, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, কেরালা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, মেঘালয় ও তেলেঙ্গানা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হিমাচল প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশ ভারতের এই ৪টি রাজ্যে অরণ্য বিধি-র অধীনে পরিবেশ অপরাধের ৮৫% ঘটনা নথিভুক্ত হয়।

আন্তর্জাল, বিপন্ন বন্যপ্রাণ ও ভারত

একটি অতি দুশ্চিন্তার খবর হল ইদানিং বন্যপ্রাণ চোরাকারবারিরা আন্তর্জালে প্রায় ১০৬টি ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে তাদের বেআইনি ব্যবসা দিন দিন বাড়িয়ে চলেছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এ তথ্যটি জানিয়েছে। এই সব ওয়েবসাইটের তালিকায় আমাজন, ক্যুইকার, স্ন্যাপডিল, ইবে এবং ইউ টিউব-ও রয়েছে। পৃথিবী জুড়ে বছরে এই চোরাশিকারের ব্যবসার আর্থিক পরিমাণ ৭-২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ভারতের ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (WCS) এর Counter Wildlife Trafficking (CWT) দল ২০২০ সালে অনলাইনে প্রাপ্য সবকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বন্যপ্রাণ চোরাকারবারের এক প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম Wildlife Poaching and Illegal Trade in India: 2020। এই প্রতিবেদনে ২০২০ সালে ভারতবর্ষের ৫২২টি বন্যপ্রাণ চোরাশিকার ও চোরাকারবারি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (৮৯টি) চোরাশিকার ও চোরাকারবারের ঘটনা ঘটেছে খুরযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের (Ungulates) ক্ষেত্রে।

WCS এর প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্যের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে যে, ২০২০ সালে ভারতে মোট ৫২২টি বন্যপ্রাণ চোরাশিকার ও চোরাকারবারের ঘটনার মধ্যে ৫১টি বেআইনি ঘটনা ঘটেছে কর্ণাটক রাজ্যে। মোট ৫২২টি বেআইনি ঘটনার ১৭৩টিই ঘটেছিল ভারতবর্ষের কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা এই দক্ষিণী রাজ্যগুলিতে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বন্যপ্রাণ অপরাধ রুখতে ভারত সরকার ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে SAWEN (South Asia Wildlife Enforcement Network) বিধি হাতে নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার আরও ৭টি দেশ, যেমন – আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মলদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা-র সাথে মিলে আন্তঃসীমানা বন্যপ্রাণ অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই চালাবে।

ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া জানাচ্ছে যে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেশে চোরাশিকারের ব্যাপক রমরমা সত্ত্বেও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ কাজে অর্থবরাদ্দের পরিমাণ কমিয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে তিনটি বন্যপ্রাণ প্রকল্পে বরাদ্দ কমেছে সেগুলি হল- ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ সালে বন্যপ্রাণীদের বাসভূমি উন্নয়নে কমেছে ৪৭%, বাঘ প্রকল্পে কমেছে ৪০% এবং হাতি প্রকল্পে কমেছে ১৬%। কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রক এর প্রকাশিত তথ্য (৯ অগাস্ট, ২০২১) অনুযায়ী ২০০৫-২০২১ এই ১৫ বছরে ভারতে মোট ৫৭৯টি বাঘ মারা পড়েছে। বিগত ৭ বছরে হাতি মারা পড়েছে ৬৯৬টি।

লকডাউন ও বন্যপ্রাণ চোরাকারবার

কোভিড-১৯ রুখতে ভারতে যখন লকডাউন চলছিল, তখন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ যথেষ্ট ব্যাহত হয়েছিল। পৃথিবী জুড়ে বন্যপ্রাণ ব্যবসা তদারককারী সংস্থা TRAFFIC এর প্রতিবেদন থেকে এটি জানা গেছে। Indian wildlife amidst the COVID-19 crisis শিরোনামের এই প্রতিবেদনটি লকডাউনের আগের ছয় সপ্তাহ (১০ ফেব্রুয়ারি – ২২ মার্চ, ২০২০) এবং লকডাউন চলাকালীন ছয় সপ্তাহের (২৩ মার্চ – ৩ মে, ২০২০) এক তুলনামূলক ছবি তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে যে, আলোচ্য সময়টিতে চোরাশিকারের ঘটনা ৩৫ থেকে বেড়ে ৮৮ হয়েছে। বন্যপ্রাণ সুরক্ষা বিধি-র অন্তর্গত তফসিল-১ প্রাণীদের চোরাশিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে। প্রাক্‌-লকডাউন পর্বের ২২টি চোরাশিকারের ঘটনা লকডাউন কালে বেড়ে ৩৭ হয়েছিল। চোরাশিকারের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে তফসিল-৩ এর অন্তর্ভুক্ত প্রাণীদের ক্ষেত্রে। প্রাক্‌-লকডাউন পর্বের ৫টি ঘটনা লকডাউনে বেড়ে দাঁড়ায় ২৮টিতে। লকডাউন কালে এ সমস্ত চোরাশিকারের ঘটনা প্রাক্‌-লকডাউন কালের তুলনায় প্রায় ১৫১% বেড়েছিল। অবশ্য এসব বেআইনি কারবারি পরিবেশ অপরাধীদের পুলিশি ধরপাকড়ের সংখ্যাও প্রাক্‌-লকডাউন পর্বের ৮৫ থেকে বেড়ে লকডাউন কালে ২২২-এ দাঁড়িয়েছিল।

ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (WTI) জানাচ্ছে যে, লকডাউনে যত চোরাশিকার হয়েছে, তার ৪৪% খুরযুক্ত প্রাণী। এদের পরেই হয়েছে বানর, প্যাঙ্গোলিন, বড় কাঠবেড়ালি, ভাম, খরগোশ, ছোট বনবিড়াল ও সজারু-র চোরাশিকার। এসব প্রাণীর চোরাশিকার প্রাক্‌-লকডাউন কালের ১৭% থেকে বেড়ে লকডাউনে ২৫% হয়েছিল। এই প্রাণীদের মূলত হত্যা করা হয়েছিল তাদের মাংস খেতে এবং স্থানীয় ব্যবসার জন্য। কারণ এসময়ে যানবাহন চলাচল ও বাজার বন্ধ থাকায় দেশের অন্যত্র বা বাইরের দেশে পাচার করা সম্ভব ছিল না বলে TRAFFIC জানাচ্ছে।
TRAFFIC আরও জানাচ্ছে যে, লকডাউনে বাঘ চোরাশিকারের ঘটনা বাড়েনি, দেশের মোট চোরাশিকারের ২০% ছিল (লকডাউনের আগেও তা-ই ছিল)। পাখি চোরাশিকার এ সময়ে ১৪% থেকে কমে ৭% হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, কিছু বড় জাতের পাখিকে এ সময়ে শিকার করা হয় তাদের মাংস খাবার জন্য। কচ্ছপ চোরাশিকার হয়নি। সামুদ্রিক প্রাণীদের চোরাশিকার প্রাক্‌-লকডাউন পর্বের ১১% থেকে কমে দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১%।

পরিবেশ শহিদ

পরিবেশ রক্ষা করতে বেআইনি কাজকর্মের বিরোধিতা করায় ২০২০ সালে দুষ্কৃতিদের হাতে সারা পৃথিবীতে ২২৭ জন মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। মানবাধিকার সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা বিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা Global Witness ২০২০ সালে Last Line of Defence নামে এক প্রতিবেদন বের করে। প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে যে, পরিবেশ কর্মিদের কাছে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলি মোটেই নিরাপদ না। ২০২০ সালে কলম্বিয়া’য় সবচেয়ে বেশি পরিবেশ কর্মী (৬৫ জন) খুন হয়। এর পরেই মেক্সিকো এবং ফিলিপাইনস্‌-এ খুন হয় যথাক্রমে ৩০ জন এবং ২৯ জন পরিবেশ কর্মী। ওই একই বছরে ব্রাজিল-এ ২০ জন, হনডুরাস-এ ১৭ জন এবং ভারতবর্ষে ৪ জন পরিবেশ কর্মীকে হত্যা করা হয়। ওপরের সংখ্যাগুলি অবশ্যই পৃথিবী জুড়ে জমি ও পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ কর্মিদের ওপর সন্ত্রাসের কোন পূর্ণাঙ্গ ছবি না। কারণ বেশ কিছু দেশে জমি ও পরিবেশ সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের ওপর খবরদারির ফলে পরিবেশ কর্মিদের ওপর নেমে আসা সন্ত্রাসের পুরো খবর মানুষের সামনে আসে না, বা এসব খবর রেখেঢেকে প্রচার করা হয়।

অতঃকিম্‌

পৃথিবীতে বেড়ে চলা পরিবেশ অপরাধ দমনের ব্যাপারে জাতিপুঞ্জ বেশ কিছু বড় ফাঁক বা গাফিলতি চিহ্নিত করেছে। এগুলি হল অপরাধের সম্পূর্ণ তথ্যের অভাব, পরিবেশ অপরাধ কী এবং সে ব্যাপারে সার্বিক সচেতনতার অভাব, অপরাধ দমনকারী আইনের ঘাটতি, পরিবেশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার অভাব, অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারী সামর্থ্যের ঘাটতি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানের অভাব এবং সর্বোপরি স্থানীয় গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে যোগসূত্রের ঘাটতি। এই বড়সড় ফাঁকগুলি বন্ধ করার জন্য নানান আন্তর্জাতিক সংস্থাকে পরিবেশ অপরাধ দমনমূলক বিভিন্ন কর্মসূচিকে সম্মিলিত ভাবে আবার চালু করা আশু প্রয়োজন। পৃথিবীর সকল দেশের সমস্ত পরিবেশ অপরাধের তথ্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে এই অপরাধকে শান্তি ও মজবুত উন্নয়নের পথে এক গুরুতর বাধা ও হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। আর সবচেয়ে যা জরুরি তা হল, এই অপরাধ নির্মূল করতে সমস্ত স্তরের পরিবেশ রক্ষাকারী নানান বিধিকে আরও শক্তিশালী করে তুলে অতি দ্রুত তার প্রয়োগ করতে হবে।

আইনি জগতে একটি কথা খুব শোনা যায় যে জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনায়েড। এখানে একটি তথ্য জানানো দরকার। ২০২০ সালে আদালতে নথিভুক্ত মোট পরিবেশ অপরাধের ঘটনা ছিল ৬১,৭৬৭টি। আগের অমীমাংসিত মামলা (৪৯৯১৫) এবং নতুন মামলা (৫৩১৩৮) শুনানির সংখ্যা মিলে আদালতে সুবিচারের জন্য ঝুলে থাকা মোট পরিবেশ মামলা শুনানির সংখ্যা ছিল ১,০৩,০৫৩টি। ওই বছর শেষে ৭৭,৩৯৮টি মামলা শুনানির জন্য বকেয়া ছিল। এসব বকেয়া মামলা এক বছরের মধ্যে মীমাংসার জন্য আদালতের রোজ প্রায় ২১২টি মামলা নিষ্পত্তির প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে একদিনের মধ্যে ২১২ টি মামলার নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়। ফলে পরিবেশ অপরাধজনিত মামলার সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে। মামলাকারীরা হতাশায় আক্রান্ত হচ্ছে, আর পরিবেশ আইন ভঙ্গকারীরা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারণ তারা বুঝেছে, তাদের শাস্তি দেবার মতো ভারতীয় বিচারব্যবস্থা এখনও সেভাবে প্রস্তুত নয়। তবু জেগে থাকে আশা। পরিবেশ অপরাধী নিয়ন্ত্রণ করা আর জীবন-জীবিকার লড়াই আজ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আন্দোলন ধ্বনিত হচ্ছে। হয়তো আগামী দিনে আন্দোলনের এই ধ্বনি নির্মূল করবে পরিবেশ আইন ভঙ্গকারী অপরাধীদের।

লিখেছেন –

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়
সভাপতি, পরিবেশ আকাদেমি
মোবাইল- ৮৪২০৭৬২৫১৭
biswajit.envlaw@gmail.com

রাহুল রায়
সদস্য, পরিবেশ আকাদেমি
মোবাইল- ৯৪৩৩৫৭৫৩৬৪
subira2263@gmail.com

Disclaimer:

  • The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
  • The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s). 
  • All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
  • No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).

Share this post

Leave a Reply