You are currently viewing একবিংশ শতাব্দীর সত্যকাম বনাম ভারতীয় সংবিধান

একবিংশ শতাব্দীর সত্যকাম বনাম ভারতীয় সংবিধান

Share this post

গঙ্গার পশ্চিমকূল বানারসী সমতুল । সেই অর্থে চন্দননগরও গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত এবং এক দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী একটি জনপদ । বিপ্লবতীর্থ চন্দননগর, ফরাসী সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগা চন্দননগর । কিন্তু এই শহরে সোনামণি বা তার সন্তানের ইতিহাস কেউ জানে না । কারণ তারা সমাজের আগাছা । নামহীন, গোত্রহীন দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা সোনামণির কোন পরিচয় নেই । তার আধারকার্ড নেই, নেই রেশনকার্ড । খুব ছোটবেলায় তার বিয়ে হয়ে সে চন্দননগর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদে স্থান পেয়েছিলো । তার স্বামী সত্যপ্রকাশ নির্মাণকর্মী এবং তার হাত ধরেই সোনামণি কাজ করে বেড়াতো বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে । সোনামণি ও সত্যপ্রকাশের এই যাযাবর জীবনে জন্ম নিয়েছিলো তিনটি সন্তান । তারাও বেড়ে উঠেছিলো চরম অযত্নে ও অবহেলার মধ্য দিয়ে । সেই বেড়ে ওঠার মধ্যে ছিলো না কোন শৈশব, কোন হাসি, কোন আনন্দ । ছিলো শুধু সর্বগ্রাসী ক্ষুধার জ্বালা । এই ক্ষুধাই ওদের কাজ করতে শিখিয়েছিলো কারণ ওরা জানে, কাজ না করলে খাদ্য নেই । বহুবছর পর সোনামণির মনে হল সে তার ফেলে আসা জন্মস্থানে ফিরবে । চন্দননগরে ফিরে এসে কখনো ইঁটখোলা আবার কখনো রাস্তার পিচ ঢালাতে স্বামী-স্ত্রী কাজ করেছে । এর মধ্যে তার চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয়েছে চন্দননগর হাসপাতালে । হাসপাতালের ডিসচার্জ সার্টিফিকেটে কেবলমাত্র সোনামণির নাম আছে কারণ সোনামণি নিজেও সঠিকভাবে জানে না তার পদবী কি ! হঠাত্‍ করেই সোনামণির মনে হল তার অন্যান্য সন্তানরা কেউ শিক্ষার সুযোগ পায়নি তাই তার সর্বশেষ সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে তাকে স্কুলে ভর্তি করার ইচ্ছে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো প্রাথমিক স্কুলের দোরগোড়ায় । স্কুলের প্রধান শিক্ষক সোনামণির শিশুর জন্ম সার্টিফিকেট চাইলেন যেটা সোনামণির কনিষ্ঠ সন্তানের নেই । তার একমাত্র পরিচয়, সে সোনামণির ছেলে । সোনামণির সেই শিশু সন্তানকে ফিরিয়ে দিলেন প্রধান শিক্ষক কারণ সে নামগোত্রহীন একটি শিশু । যদিও ভারতবর্ষে সাংবিধানিকভাবে প্রত্যেক শিশুর শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু পদবীহীন, গোত্রহীন সোনামণির সন্তানের সেই অধিকার নেই । প্রত্যেক বছর এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারি নিয়ম মেনে ১৫ই আগস্ট এবং ২৬শে জানুয়ারি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়, গাওয়া হয় – সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্থান হামারা । কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর গোত্রহীন, পদবীবিহীন সত্যকাম শিক্ষার অঙ্গনে ব্রাত্য ।

সোনামণি সত্যকামের এই ঘটনা সতত বিরাজমান । আমরা শহরে, গ্রামে সর্বত্র ইঁট দিয়ে তৈরি দালানে নিশ্চিন্তে বসবাস করি । কিন্তু চন্দননগরের ইঁটখোলায় কিংবা দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণকার্যে কর্মরত লক্ষ লক্ষ শ্রমিকরা চিরকালই থেকে যান এমনই নামহীন, গোত্রহীন । ভারতবর্ষের বিভিন্ন ইঁটখোলাতে লক্ষ লক্ষ আদিবাসী শ্রমিক কাজ করেন । সেখানেই তাঁদের সন্তান সন্ততিরা বেড়ে ওঠে কিন্তু তাদের শিক্ষার সুযোগ নেই কারণ তাদের বেশিরভাগ মানুষেরই কোন পরিচয়পত্র নেই । ফলত: তাঁদের সন্তানরা সমস্ত রকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। সাম্প্রতিককালে হুগলীর বলাগড়ে কিংবা চন্দননগরের আশেপাশে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিযায়ী শ্রমিকদের শিক্ষা দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং বলাগড়ে কয়েকজন অধ্যাপকের সহায়তায় সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পরিযায়ী শ্রমিকদের শিশুরা পড়ার সুযোগ পেয়েছে । কিন্তু তাদেরও আধার কার্ড নেই । প্রশাসনিক দপ্তরে বারবার অনুরোধ করা সত্বেও প্রশাসনের সময় নেই কারণ তারা “ব্যস্ত” । সরকারি আধিকারিকদের ব্যস্ততার জগতে এই নামগোত্রহীন সত্যকামদের কোন স্থান নেই । কারণ তাদের বাবা-মায়েদেরও কোন রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্র নেই । রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন দায় নেই এঁদের জীবনগ্লানিকে নিরাময় করার ।

এই অনাথ নামহীন গোত্রহীন শিশুদের সুরক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জির ফলশ্রুতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন দপ্তর বিষয়টিকে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের মহিলা ও শিশু সুরক্ষা দপ্তরকে অনুরোধ করেছিলেন, এখন থেকে এক বছর আগে । তারপরে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে নিরুত্তাপ । রাজ্য সরকারের শ্রম দপ্তর রাজ্যের নারী ও শিশু সুরক্ষা দপ্তরে বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কথা বলেই নিজেদের দায় সেরে ফেলে নীরব হয়ে গেছেন । রাজ্যের নারী ও শিশু সুরক্ষা দপ্তরও এই এক বছরের মধ্যে বিশেষ কিছু ভেবে উঠতে পারেননি । কেবলমাত্র জানিয়ে দিয়েছেন তাঁদের বিশেষ কিছু করার নেই কেননা কারা “অনাথ শিশু” এই আইনি ব্যাখ্যাই নাকি স্পষ্ট নয় ।

গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই ধর্মীয় কাজে সবাই ব্যস্ত । কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কেবলমাত্র মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়ানো পথশিশুদের জন্য কারো কোনরকম ব্যস্ততা নেই । জবালার পুত্র সত্যকাম পৌঁছতে পেরেছিলেন মহর্ষি গৌতমের কাছে এবং মহর্ষি গৌতম তাঁকে স্থান দিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষার প্রাঙ্গণে । কিন্তু আধুনিক জগতের “উন্নত” ব্যবস্থায় শিক্ষার অঙ্গন থেকে ব্রাত্য থেকে যায় আজকের সত্যকাম-রা, যদিও সংবিধানে উচ্চারিত হয়েছে শিক্ষা মানুষের অধিকার । যথারীতি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি পালন করা হবে আগামী ২৫শে বৈশাখ, কিন্তু অপঠিত থেকে যাবে কবিগুরুর “ব্রাহ্মণ” নামক কবিতাটি । প্রশ্ন থেকেই যায় আমরা কি সত্যিই রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেছি না রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে আত্মতৃপ্তি অনুভব করছি শুধুমাত্র ? রবীন্দ্রদর্শন বা রবীন্দ্রচেতনা বোধহয় আমাদের জীবনে চিরকাল অধরাই থেকে যাবে ।

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় (পরিবেশ ও সমাজকর্মী )
চলভাষ – ৮৪২০৭৬২৫১৭
ই-মেল – biswajit.envlaw@gmail.com

Disclaimer:

  • The views expressed in the articles which are published in this website (www.doverthinker.com) asserts that the opinions expressed in an article or any written material are those of the author and not the opinion of the website (www.doverthinker.com).
  • The www.doverthinker.com assumes no responsibility or liability for any error(s) or omission(s) in the content(s) and/or the article(s). The information contained in www.doverthinker.com is provided on an “as is” basis as provided by the author(s). 
  • All the information published in www.doverthinker.com is in good faith and for general information purpose only.
  • No warranties from our site will be given for the completeness, reliability and accuracy of the information in the published article'(s).

Share this post

Leave a Reply